সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

রবীন্দ্র-স্মৃতি - কবি জসীম উদ্দীন

যার ভেতর অনুপ্রেরণা থাকে সেই পারে অপরের প্রেরণা যোগাতে। বড় মনের মানুষেরাই হতে পারে বড় মাপের কবি। তারা নিজেরাও যেমন বড় হয়, অপরকেও বড় হতে সহায়তা করে। আর তাই কবি জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথায় আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য এবং মধুর স্মৃতিচারণ করতে দেখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে সেই মধুর স্মৃতিচারণ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ সাপ্তাহিক বুধবারের পক্ষ থেকে পেশ করা হলো।
অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বন্ধু। দুইজনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়া একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে রওয়ানা হইলাম। তখন বর্ষাকাল। কদমফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ তোড়া নানা রকমের ফুলদানিতে সাজানো। আধ-ফোটা মোটা মোটা কেয়াফুলের গুচ্ছগুলি কবির সামনে দুইটি ফুলদানি হইতে গন্ধ ছড়াইতেছিল। বেলিফুলের দু’গাছি মালা কবির পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। মনে হইতেছিল, বাংলাদেশের বর্ষা ঋতুর খানিকটা যেন ধরিয়া আনিয়া এই গৃহের মধ্যে জীবন্ত করিয়া রাখা হইয়াছে। চারিধার হইতে সবকিছুই মূক ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলিতেছিল। কবি যদি আমার সঙ্গে কোনো কথাই না বলিতেন, তবু আমি অনুতাপ করিতাম না। সালাম জানাইয়া কম্পিত হস্তে আমি নকশিকাঁথার মাঠ আর রাখালী পুস্তক দুইখানি কবিকে উপহার দিলাম। কবি বই দুইখানি একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলাদেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখিয়াছ। তোমার বই আমি পড়িব’।

প্রথম পরিচয়ের উত্তেজনায় সেদিন কবির সঙ্গে আর কি কি আলাপ হইয়াছিল, আজ ভালো করিয়া মনে নাই। ইহার দুই-তিনদিন দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মাধ্যম ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘তুমি কবিকে বই দিয়ে এসেছিলে। আজ দুপুরে আমাদের  সামনে কবি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কবিতার প্রশংসা করলেন। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে প্রকাশ করেছেন, তিনি তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবেন।’

পরদিন সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। কবি আমার বই দুইখানির প্রশংসা করিলেন। বলিলেন, ‘আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েই তোমার বই দুইখানার উপর বিস্তৃত সমালোচনা লিখে পাঠাব। তুমি শান্তিনিকেতনে এসে থাকো। ওখানে আমি তোমার একটা বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, ‘এখানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তো পড়া হবে না।’

কবি বলিলেন, ‘ওখান থেকে ইচ্ছে করলে তুমি প্রাইভেট এমএ পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি সে বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি উত্তরে বলিলাম, ‘ভালো করে ভেবে দেখে আমি আপনাকে পরে জানাব।’

কলকাতায় আমার সবচাইতে আপনজন ড. দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমাকে কলিকাতা ছাড়িয়া শান্তিনিকেতনে যাইতে নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘কবি যদি এত বৃদ্ধ না হতেন তবে আমি তোমাকে ওখানে যেতে বলতাম। কিন্তু কবি কতকাল বেঁচে থাকবেন, বলা যায় না। এখান থেকে এমএ পাস করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করো। ওখানকার আশ্রয় বহুদিন পাওয়ার সৌভাগ্য তোমার না-ও হতে পারে।’ আমার আর শান্তিনিকেতনে যাওয়া হইল না।

প্রায় দুই মাস হইয়া গেল। কবি আমার বই-এর সমালোচনা পাঠাইলেন না। মোহনলালকে দিয়া কবিকে পত্র পাঠাইলাম। কবি একটা ছোট্ট চিঠিতে মোহনলালকে লিখিয়া পাঠাইলেন, ‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ কবির এই কথাগুলি নকশিকাঁথার মাঠে ছাপা হইলে বাংলাদেশের বহু সাহিত্যিক ইহার প্রশংসা করিয়াছিলেন। যাঁহারা বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে প্রস্ত্তত হইতেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই প্রশংসার পরে তাঁহারা আর সে বিষয়ে সাহসী হইলেন না।

ইহার পর রবীন্দ্রনাথ যখনই কলিকাতা আসিয়াছেন, আমি অবসর পাইলেই গিয়া দেখা করিয়াছি। আমাকে দেখিলেই কবি তাঁর বিগতকালের পদ্মাচরের জীবন লইয়া আলোচনা করিতেন। তখন আমি বালুচর বইয়ের কবিতাগুলি লিখিতেছি। ইহার অধিকাংশ কবিতাই ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। মাসিকপত্রে ইহার অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। সমালোচকেরা বলিতে লাগিলেন, ‘তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন করো।’

একদিন কবিকে এই কথা বলিলাম। কবি বলিলেন, ‘ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার করো। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মতো। তাতে কোনো প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।’

রাজরানী নাটকখানি নতুন করিয়া লিখিয়া রবীন্দ্রনাথ ইহার তপতী নামকরণ করিলেন। এই নাটক মহাসমারোহে কবি কলিকাতায় অভিনয় করিলেন। এই অভিনয়ে কবি রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধ কি করিয়া প্রেমের অভিনয় করিবেন, তাঁহার শাদা দাড়িরই বা কি হইবে, অভিনয়ের পূর্বে এইসব ভাবিয়া কিছুই কূল- কিনারা পাইলাম না। কিন্তু অভিনয়ের সময় দেখা গেল দাড়িতে কালো রং মাখাইয়া মুখের দুই পাশে গালপাট্টা তুলিয়া দিয়া কবি এক তরুণ যুবকের বেশে মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তপতী নাটকে রাজার ব্যর্থ প্রেমের সেই মর্মান্তিক হাহাকার কবির কণ্ঠমাধুর্যে আর আন্তরিক অভিনয় নৈপুণ্যে মঞ্চের উপর জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতা দেখিয়াছি। তাহাতে এই পরিবর্তন ও এত কাটাকুটি যে দেখিয়া অবাক হইতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি কিছু করিয়া তৃপ্ত হইতে জানিত না। তিনি আজীবন এতো গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাহার প্রত্যেকখানিতে তাঁহার মনের একান্ত যত্নের ছাপ লাগিয়া রহিয়াছে। গ্রন্থগুলি লিখিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি অপরকে দিয়া নকল করান নাই। যতবার নকল করিতে হয় নিজেই করিয়াছেন এবং  প্রত্যেকবারেই সেই রচনার ভিতর তাঁহার সৃজনীশক্তির অপূর্ব কারুকার্য রাখিয়া গিয়াছেন।

তপতীর পরেও নাটক রচনার নেশা রবীন্দ্রনাথকে পাইয়া বসিয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে একদিন আমি পাড়াগাঁয়ের লোকনাট্য, আসমান সিংহের পালার উল্লেখ করিলাম। কথা প্রসঙ্গে কবি আমাকে বলিলেন, ‘তুমি লেখো না একটা গ্রাম্য নাটক।’ আমি বলিলাম, ‘নাটক আমি একটা লিখেছি। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ পড়ে বলিলেন, নাটক লেখার শক্তি তোমার নেই।’ কবি একটু জোরের সঙ্গে উত্তর করিলেন, ‘অবন নাটকের কি বোঝে? তুমি লেখো একটা নাটক তোমাদের গ্রাম দেশের কাহিনী নিয়ে। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে দেবো।’ আমি বলিলাম, ‘একটা প্লট যদি দেন তবে আর-একবার চেষ্টা করে দেখি।’ কবি বলিলেন, ‘আজ নয়, কাল সকালে এসো।’ কবির এই প্লট অবলম্বন করিয়া আমি নাটক রচনা করিয়াছিলাম। দুই- তিনবার অদলবদল না করিয়া কিছুতেই কোনো লেখা আমি প্রকাশ করি না। তাই কবি জীবিত থাকিতে তাঁহাকে এই নাটক দেখাইতে পারি নাই। পল্লীবধূ নাম দিয়া এই নাটক কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে। ঢাকা বেতারে এই নাটক অভিনীত হইয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করিয়াছে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বাঁচিয়া থাকিতেন, তাঁহাকে এই নাটক উপহার দিয়া মনে মনে কতই না আনন্দ পাইতাম।