বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১

সিনেমার মৃত্যু এবং সাই মিং লিয়াং

২৬ মার্চ ২০১০, মালয়েশিয়ার বংশোদ্ভূত তাইওয়ানে বেড়ে ওঠা সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সাই মিং লিয়াং তাইওয়ানের ন্যাশনাল সেন্টার ইউনিভাসির্টির একটি থিয়েটার হলে তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’-এর প্রিমিয়ার উপলক্ষে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতায় সিনেমার মৃত্যু, ফ্রান্সের অন্যতম চিত্রনির্মাতা ত্রুফোর প্রভাব ও অন্যান্য প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ প্রদান করেন।

সাই মিং লিয়াং মালয়েশিয়ার কুচিং প্রদেশে ১৯৫৭ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের প্রথম ২০টি বছর মালয়েশিয়ায় অতিবাহিত হয়। তারপর বাবার কর্মসূত্রে তাইওয়ানের তাইপেতে চলে আসেন। তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সিনেমা বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। পরবর্তীতে থিয়েটারের প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্র পরিচালক এবং হংকং টেলিভিশনের নাট্য পরিচালক হিসেবে নানা কাজে লিপ্ত হন। তবে চিত্র পরিচালক হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন বেশি। ১৯৯৪ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার নির্মিত Vive L’Amour ছবিটি গোল্ডেন লায়ন (শ্রেষ্ঠ ছবি) পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৯৭ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার ‘রিভার’ ছবিটি সিলভার বিয়ার বা শ্রেষ্ঠ জুরি প্রাইজ লাভ করে। ‘দ্য হোল’ ছবিটি ১৯৯৮ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে FIPRESCI award পায়। নান্দনিক সৌন্দর্য্যের জন্য ২০০৫ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে The Wayward Cloud ছবি আলফ্রেড বাউয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং সিলভার বিয়ার পায়। ২০০৭-এ I don’t Want to Sleep Alone ছবিটি যা মালয়েশিয়ায় চিত্রায়িত হয় এবং যে ছবিটি সেদেশের সংস্কৃতিগত, নৃতাত্ত্বিকগত এবং জাতিগত নানান অনালোকিত বিষয় উপস্থাপন করার কারণে মালয়েশিয়ান সেন্সরশিপ প্রথমে ছবিটি মুক্তি দিতে অপারগতা জানায়। পরে ছবির কিছু অংশ বাদ দিলে ছবিটি মুক্তি পায়। বছর দুয়েক আগে লুভ মিউজিয়ামের আর্থিক সহায়তায় তার সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’ ইতিমধ্যে দর্শককুলে বেশ আলোড়ন তুলেছে। সব থেকে যা উল্লেখযোগ্য তা হলো- ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বিশ্বের ৪০টি শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালকের মাঝে তাকে ১৮তম স্থানে স্থান দিয়ে সম্মানিত করে।
  সেই লিয়াং তাইওয়ানের একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হলে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন। পরিত্যক্ত সেই সিনেমা হল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শেষবার যখন এই থিয়েটার হলে আসি সেটা ছিল ২০০৩, যখন লি ক্যাং শেং (লিয়াংয়ের একমাত্র অভিনেতা, যিনি লিয়াংয়ের সব ছবিতে অভিনয় করেন, যাকে ছাড়া লিয়াংয়ের ছবি পূর্ণ হয় না) অভিনীত The missing-এর প্রিমিয়ার শো দেখানো হয়। এখানে যারা আছেন তাদের মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষই জানেন, এই হলের আসনগুলো ফু-হো থিয়েটার, যে থিয়েটারে ৮ থেকে ৯শ’ দর্শকের বসার ব্যবস্থা ছিল, সেখান থেকে আনা হয়েছে। সেই থিয়েটারে আমার অন্য একটি ছবি Goodbye, Dragon Inn’র (2003) শুটিং হয়েছিল। সেই সময় থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি সিনেমা হল বা থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠার একান্ত সমর্থক ছিলাম। ফু-হো থিয়েটার হলটি ভেঙে দিলে সেখানকার বেশিরভাগ আসন এখানে স্থানান্তরিত করা হয়, যেগুলো স্ত্তপ করে রাখা হয়েছিল অনেকদিন। আমার খুব ভালো লাগছে সেই হলের আসনগুলো এখানে কাজে লাগানো হয়েছে দেখে।…থিয়েটার হল সিনেমা শিল্পের অন্যতম একটি অপরিহার্য অংশও বটে।’’
    সিনেমার প্রতি শুধু প্রেম নয়, দরদ থাকলেই কেউ এভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং তা বাস্তবায়িত করতে পারেন। আমরা আমাদের অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের কথা কী ভাবতে পারি না, যেখানে দেশীয় ছবির পাশাপাশি পৃথিবীর নান্দনিক, সুস্থ, সুন্দর ছবিগুলো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিতভাবে দেখার সুযোগ পাবে?
    ভেনিসে তার বেশ কিছু ছবির একবার প্রদর্শনী হলে সেখানকার একজন ডাচ সমালোচক লিয়াংয়ের ছবি সম্পর্কে একটি চমৎকার মন্তব্য করেন এবং তা হলো – ‘‘সাইয়ের কাজ, সিনেমার মৃত্যু ঘটানোর মতো কাজ এবং একই সঙ্গে তা (সিনেমা) পুনরুজ্জীবিত করারও কাজ।’’ এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে লিয়াং বলেন, ‘‘তার মন্তব্যের সব থেকে উদ্দীপক দিকটি হচ্ছে সিনেমার ‘পুনরুজ্জীবন’। সিনেমার ইতিহাসে আমরা প্রায়ই সমালোচকদের মুখে সিনেমার মৃত্যুর কথা শুনে থাকি। আশির দশকে এই ধরনের একটি আলোচনার ঝড় উঠেছিল যে, তাইওয়ানের ছবির মৃত্যু ঘটেছে। আসলে তা কী ছিল? এই আলোচনায় দর্শকরা বেশ ঘাবড়ে যান। গত বছর একজন জ্যেষ্ঠ জার্মান চিত্রপরিচালকের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং তিনিও বলেন, ১৯৮৪-এর দিকে, জার্মানির অন্যতম পৃথিবী খ্যাত চিত্র পরিচালক রেইনার ওয়ারনার ফাসবিন্ডারের মৃত্যুর (১৯৮২) পর পরই জার্মানিতেও ঠিক একই রকম আওয়াজ উঠেছিল অর্থাৎ জার্মান ছবির মৃত্যু ঘটে গেছে। জার্মান সরকার সিনেমার জন্যে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় এবং চিত্রনির্মাতারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সরকারি ঘোষণায় বলা হলো ছবি নির্মিত হবে সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য, ঠিক যেমন হলিউডে করা হয়। ফলে আশির দশকের পর থেকে যেসব ছবি সেখানে নির্মাণ করা হলো তার কোনো পরিচালকের নামই আমরা এখন আর করতে পারি না, অথচ আশির দশকের আগের সময়কার নির্মাতা যেমন ওয়ারনার হারজগ, ফাসবিন্ডার, উইম ওয়েন্ডার এদের নাম এখনো আমরা স্মরণ করি। আমি মনে করি এসবই বাজারিকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটু কমবেশি হলেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্প এরকম জাতীয় সিনেমার মৃত্যু ঘণ্টার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বা করছে। ছবির এই মৃত্যু বা উজ্জীবিত অবস্থা যাই হোক না কেন, আমার ছোটবেলাকার সময়ের কথা আমি বলতে পারি সেই সময়ে জনগণের জায়গার জন্য সিনেমা একটি অত্যন্ত আবশ্যকীয় স্থান ছিল। যা আপনারা আমার ‘ফেস’ ছবিটিতে দেখতে পাবেন।’’ অর্থাৎ সিনেমার যে মৃত্যু নেই, মৃত্যু হতে পারে না সে কথাই লিয়াং চমৎকার করে উপস্থাপিত করেছেন। বলাই বাহুল্য, আমাদের আজকের সিনেমা শিল্পের এই আকালের যুগে আমাদের চিত্রনির্মাতারাও লিয়াংয়ের কাছ থেকে প্রচুর অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।
   শিল্প ও অ-শিল্প সম্পর্কে বলেন, ‘‘ছবি যদি শিল্প হয় তাহলে সেই কাজের ভেতর অবশ্যই একজন শিল্পীর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অবশ্যই কিছু বাণিজ্যিক ছবি নির্মিত হবে যেগুলোতে অনেক সময় শৈলীর ছোঁয়া পাওয়া যায় কিন্তু আমি শুধু মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে ছবি নির্মাণ করি না। আমার ছবি আমার সৃষ্টির প্রতিফলন; আমার ছবি আমার জীবন থেকে অবিচ্ছিন্ন।’’ এই হলেন সাই মিং লিয়াং, ছবিকে যিনি মনেপ্রাণে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কোনো মুনাফা উপার্জনের পথে হাঁটেননি। হাঁটেননি বলেই একের পর এক তার প্রায় সব ছবি পুরস্কৃত হয়েছে এবং হবে। এই প্রসঙ্গে তার সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানে একটি কোরিয়ান রেস্তোরাঁয় বারবিকিউ খাওয়ার অভিজ্ঞতার একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানে তিনি যখন খেতে বসলেন বারবিকিউর সঙ্গে লেটুস পাতা বা কোরিয়ান হট সস দেওয়ার কথা বললে মালিক উত্তরে বলেন, ‘‘আমরা তাইওয়ানিরা সাধারণত বারবিকিউয়ের সঙ্গে এসব পরিবেশন করি না।’’ লিয়াং তখন মুচকি হেসে তার বক্তৃতায় বলছেন, ‘‘তাহলে স্থানীয় স্বাদ বজায় রেখে শুধু টাকা উপার্জনের জন্য কোরিয়ান রেস্তোরাঁ খোলার কী দরকার? আপনি যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন কী কারণে কোরিয়ান রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছে। সেখানে দেখবেন বেশ কিছু কোরিয়ান টিভির পপুলার সোপ অপেরার পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে দর্শকের দৃষ্টি পপ-কোরিয়ান ধারার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।’’ অনেকটা আমাদের দেশের বড় বিপণিগুলোতে ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য যেমন আমরা ভারতীয় ছবির বিভিন্ন বলিউড স্টারদের ছবি ঝুলিয়ে রাখি।
    লিয়াং দুঃখ প্রকাশ করেন তার বিশ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা ইতালির নিও রিয়ালিজম বা ফাসবিন্ডারের কোন ছবি দেখা হয়নি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার বা স্থানীয় ফিল্ম স্টুডিওগুলো খুব বাছাই করা ছবি নির্মাণ বা আমদানি করত। তারা শুধু ছবির বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে ছবির আমদানি বা নির্মাণ করত। ভালো ছবি দেখার জন্য তাদের কোনো ফেস্টিভ্যালের অপেক্ষা করতে হতো। যদিও পরবর্তীতে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়, তবু বেশিরভাগ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে হয় শুধু বাণিজ্যিক ছবি চলে না হলে অন্য কোনো ছবি নয়। লিয়াংয়ের বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দেশের সিনেমা শিল্পের অনেক মিল খুঁজে পাই। তবে তাইওয়ানে এই শিল্পের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। আশির দশকে মার্শাল ল’ তুলে নেয়ার পর হলিউডের মূল ধারার ছবির আগমন ঘটে, সেন্সরশিপের কড়াকড়ি শিথিল হয় ফলে বেশ স্বাধীনভাবে এখন নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করতে পারেন।
   তার ‘ফেস’ ছবি প্রসঙ্গে লিয়াং বেশ কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আমাদের দেন। যারা ত্রুফোর ‘ফোর হান্ডড্রেড ব্লোউজ’ দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই সেই ছোট্ট বালকটির কথা মনে আছে, সেই বালক পরবর্তীতে যিনি Jean-Pierre Leaud নামে সিনেমা জগতের অভিনয়ে বেশ নাম কুড়িছেন, লুভ মিউজিয়াম যখন তাকে ছবি করার জন্য আর্থিক সহায়তার কথা বলেন এবং জিজ্ঞেস করেন কাকে নিয়ে তিনি ছবি নির্মাণ করতে চান, লিয়াং এক বাক্যে তার নাম বলে ফেলেন। আরো জানান এই লুভ মিউজিয়ামেই তাকে নিয়ে সেই ছবির শুটিং পর্ব পরিচালনা করবেন। কারণ হিসেবে লিয়াং বেশ চমৎকার একটি কথা বলেন, ‘‘জ্যঁ পিয়েরকে মিউজিয়ামেই ঠাঁই দিতে হবে, না হলে খুব দ্রুত তাকে সবাই ভুলে যাবে। কেননা সিনেমার ইতিহাসে তার নাম থেকে গেলেও, ফ্রান্সের বর্তমান বা পরবর্তী প্রজন্ম তাকে ভুলে যাবে। অর্থাৎ আমি খুব সচেতনভাবেই তাকে নিয়ে এভাবে ছবি নির্মাণ করেছি, কেননা সাধারণ এবং এশিয়ান দর্শক ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা জার্মান নিউ ওয়েভ সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখে। ছবিটির মাধ্যমে সেসব ধারার কথা আবার সবার স্মরণে আসবে। অনেকে ছবিটিকে আত্মপ্রতিকৃতি বলে সমালোচনা করেছেন। আমি মূলত জীবন এবং সৃষ্টির মাঝের সম্পর্ক খুঁজে বেড়াবার চেষ্টা করেছি। মানুষ তার বার্ধক্য, জরা, মৃত্যু থেকে রেহাই পেতে পারে না। কিন্তু এসব মেনে নিয়েও বলা যায় জীবন আসলে একটি অনন্ত বৃত্তের, জীবনের ভেতর থেকেই জীবন ফিরে আসে।’’ অসাধারণ দার্শনিক জায়গা থেকে নির্মিত হয়েছে তার সর্বশেষ ছবি ‘ফেস’।
   সিনেমার বাণিজ্যিকীকরণের চরম বিরোধী লিয়াং। তার ভাষায়, ‘‘ফিল্ম শুধু বিনোদনের ক্ষেত্র নয়। জ্যান হাং তেজ যেমন বলেছেন, কোনো বই পড়ার অর্থ নিজেকে বদলে দেওয়া, সিনেমাও ঠিক তাই। এখন মানুষ বই পড়ার চেয়ে সিনেমা দেখে অধিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন ধরনের সিনেমা সে দেখে? বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ছবি। আমার ‘ফেস’ ছবি দেখে হংকংয়ের একজন দর্শক বলেছেন, ‘যাচ্ছেতাই’ আবার হংকংয়েরই আরেকজন দর্শক বলেছেন, ‘ছবিটি দেখে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। প্রতিটি শট বলে দিচ্ছিলো কতটা শ্রম আর কষ্ট দিয়ে তৈরি ছবিটি।’ ছবি দেখা আসলে দু’ঘণ্টা হলে বসে ছবির সঙ্গে ভালোবাসাবাসির বিষয়। এর সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকে মনে করেন ছবি নির্মাণের মাধ্যমে সেই দেশের বিজ্ঞাপনেরও একটা ব্যবস্থা করে। আমি মোটেও তা মনে করি না। তাই আমি যা মনে করি তাই নির্মাণ করি। কে দেখলো আর না দেখলো তার ধার ধারি না। একবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় ছবি বিষয়ে কথা বলার জন্য। সেখানে দর্শকের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন রাখা হয় আর তা হলো, ‘ সিনেমার বস কে?’ একটি ছাত্র বললো ‘আমি’। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘না। ছবি নির্মাণ করি আমি, কাজেই তুমি আমার বস কখনো হতে পারো না। তুমি আমার ছবি দেখতে নাও পার, কিন্তু তুমি কখনোই আমার বস্ হতে পার না, যেমন আমিও পারি না তোমার বস হতে।’
    ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ থেকে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন লিয়াং। ছবির শেষ দৃশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ছেলেটি যখন বিচে গিয়ে দর্শকের দিকে মুখ ঘোরায় তখনই দর্শক এবং ছবির পর্দা একটি মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ছবি তখন দর্শকের সঙ্গে যেন মুখোমুখি কথা বলে ওঠে। সে সমস্যার কথা জানায় কিন্তু কোনো সমাধান দেয় না। ছবিটি আপনাকে কোনো উৎসাহ যোগাবে না, কিন্তু বার বার আপনাকে ধাওয়া করে বেড়াবে। কেন? এখানেই কল্পনার শক্তি লুকিয়ে থাকে। মানুষকে ভাবিয়ে তোলার শক্তিটি লুকিয়ে থাকে। আর আমার ছবিতে এই ভাবিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।’’ আমরাও লিয়াংয়ের সঙ্গে একমত। যে কোনো শিল্পমন্ডিত ভালো মানের ছবি মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। নিজের বা নিজেদের অবয়বে নিজেকে বা নিজেদের দেখতে সহায়তা করে। কোনো ছবি দেখে যদি ভাবতেই না পারলাম, চিন্তা করতে না শিখলাম, নিজেকে বা নিজেদের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে না পারলাম তাহলে ছবি নির্মাণের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই ছবি যত মূল্যেই বিক্রীত হোক তাতে কিছু এসে যায় না। এই কল্পনা শক্তির মাঝেই বেঁচে থাকে সিনেমা। আশা করি আমাদের নির্মাতারও লিয়াংয়ের মতো ব্যবসা সফল নয়, ভাবনা সফল ছবি নির্মাণে আরও উদ্যোগী হবেন। তাহলে আমাদের সিনেমাকেও আমরা এভাবেই বেঁচে থাকতে সহায়তা করতে পারব।
             ---ফ্লোরা সরকার

বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মকবুল ফিদা হুসেন এবং হিন্দু মৌলবাদ

যদি প্রশ্ন করা হয় শিল্প কী, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় শিল্প কেন? কারণ শিল্প সৃষ্টির একটাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে আর তা হলো – সুন্দরের সৃষ্টি। আর আমরা সবাই জানি যা আনন্দ প্রদান করে তা-ই সুন্দর। প্রকৃতি সুন্দর বলেই আমাদের তা আনন্দ দান করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রদানের মাঝে কোনো কৃত্রিমতা নেই। উন্মুক্ত বা নগ্ন হয়েই সে নিজেকে প্রকাশ করে। প্রকৃতি অকৃত্রিম বলেই সুন্দর এবং সেই প্রকৃত সুন্দরের কারণেই আমরা আনন্দে অবগাহন করতে পারি। খাঁটি শিল্পী তাই প্রকৃতির মতো অকৃত্রিম হতে চায়। তার শিল্পসাধনার একটাই লক্ষ্য থাকে, আর তা হলো সুন্দরের সাধনা। কিন্তু এই সুন্দরের সাধনার পথটি বেছে নেওয়া এতো সহজ কাজ নয়। আর তাই সবাই শিল্পী হতে পারে না। যে কারণে কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন – ‘‘কেউ কেউ কবি, সবাই কবি নয়।’’
সুন্দরের পথ বেয়ে শিল্পের নন্দনতত্ত্বে শ্লীল আর অশ্লীলের প্রশ্ন দেখা দেয়। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসো একজন নারীর সুন্দর নগ্ন শরীরকে শ্লীল বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন। যা দেখতে অসুন্দর তা-ই অশ্লীল। তাই ‘নগ্ন’ আর ‘উলঙ্গ’, ইংরেজিতে যাকে ‘ন্যুড’ আর ‘ন্যাকেড’ বলা হয় শব্দ দুটো এক নয়। নগ্নতার মাঝে থাকে সৌন্দর্য, আর উলঙ্গের মাঝে থাকে কদর্য। এই নগ্নতা আর উলঙ্গের মাঝের ভেদরেখা করতে পারেননি বলেই মকবুল ফিদা হুসেনকে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী দেশছাড়া হতে বাধ্য করেছিল। যে ফিদা ২০০৬ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করেন এবং বাধ্য হয়ে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। বিদেশে অবস্থানরত অবস্থাতেই ৮ জুন লন্ডনে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে পঁচানববই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যে ফিদা সুন্দরের অন্বেষণে সারাজীবন তার চিত্রকর্মের কর্মজীবন অতিবাহিত করেন এমন শিল্পীর এরকম করুণ মৃত্যু সত্যি দুঃখজনক।

ফিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হতে শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। আমাদের মনে রাখতে হবে এটা হচ্ছে সেই বছর যে বছর ভারতের নির্বাচনের রাজনীতিতে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে বা উদীয়মান হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে ভুপাল থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘বিচার মীমাংসা’য় ওম নাগপালের এক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল – ‘‘উনি (ফিদা) কি একজন শিল্পী না কসাই?’’ এবং সেই সঙ্গে ১৯৭০ সালে ফিদার অাঁকা সরস্বতী দেবীর নগ্ন চিত্রটির প্রতিরূপ ছাপা হয়। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং শিবসেনা নেতা প্রমোদ নাভালকার পত্রিকার রিপোর্টের মাধ্যমে ওই প্রবন্ধ সম্পর্কে অবগত হন এবং মূল প্রবন্ধটি পড়ে তা মুম্বাই পুলিশ কমিশনারের কাছে পত্রযোগে বিষয়টি অবগত করান। মুম্বাই পুলিশ সেই পত্রটি অভিযোগ আকারে গ্রহণ করে এবং ১৯৯৬-এর ৮ অক্টোবর, ভারতীয় পেনাল কোড, ধারা ২৯৫-এ (বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাগ বা ঘৃণার উদ্রেক ইত্যাদি) এবং ধারা ২৯৫ (সুচিন্তিত এবং বিদ্বেষপ্রসূত কাজ যা যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতির ওপর প্রচন্ড আঘাত হানে)-এর অধীনে ফিদার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এর পরপরই বজরঙ দল নামের হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল আহমেদাবাদের হারউইট গ্যালারির বিখ্যাত হুসেন- দোশি গুফা কমপ্লেক্সে হানা দিয়ে হুসেনের চিত্রকর্মগুলো ধ্বংস করে, যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ রুপি। হুসেনের প্রায় সব চিত্রকর্ম নষ্ট করা হলো, এমনকি এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তার সযত্নে অঙ্কিত বৌদ্ধ, হনুমান এবং গণেশের চিত্রকর্ম পর্যন্ত বাদ পড়লো না।

মুম্বাই, দিল্লি এবং আহমেদাবাদের শিল্পীরা হুসেনের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদকারীরা সুপ্রাচীন হোসেলা মন্দিরের সরস্বতীর বিভিন্ন নগ্ন মূর্তির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ভারতীয় চিত্রশিল্পে নগণ দেবদেবী বা নগ্নিকার রূপায়ন ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ফিদা সেই ঐতিহ্যকেই বহন করেছেন। লন্ডনে হুসেন একটি বিবৃতি দিয়ে জানালেন,এ চিত্র তিনি কাউকে আঘাত দেয়ার অভিপ্রায়ে অাঁকেননি। তবে তিনি যদি তাই করে থাকেন, সেজন্যে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু তাই নয়, ফিদা মনে করেন- ‘‘আমার কাজ কাউকে আঘাত দিলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ আমি মনে করি মানবতার প্রশ্নটি শিল্পের আগে স্থান পাবার বিষয়। কাজেই আমি কখনো কারোর অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না।’’ এতোসব সত্ত্বেও হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে রেহাই তো দেয়ইনি, তাকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসে। ১৯৯৮ সালে নগ্ন সীতাকে হনুমানের লেজের ওপর অঙ্কন করায় আবার তিনি আক্রোশের মুখে পড়েন। ২০০৬ সালে ফিদার অঙ্কিত ‘‘নগ্ন ভারতমাতা’’ চিত্রটির জন্য তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা হয়।  অশোক পান্ডে যিনি হিন্দু ল’ বোর্ডের প্রধান, ফিদাকে মেরে ফেলার জন্যে ১০১ কোটি রুপি প্রদানের ঘোষণা করেন। এভাবে মৃত্যু পরোয়ানা প্রচার হতে থাকে, সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হামলা। অবশ্য ভারতমাতা ক্যাপশনটি ফিদার দেওয়া ছিল না। এ ক্যাপশন দিয়েছিলেন তার ছবির প্রদর্শকরা।

যাহোক অবশেষে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কিশান কালু তার যুগান্তকারী রায় দেন। সেই রায়ের সারমর্মে যা বলা হয় তা হলো – ফিদার ভারতমাতা চিত্রটি অশ্লীল নয়, নয় কামোদ্দীপক এবং এই চিত্র কোনো বিকৃত কামনার উদ্রেক করে না। চরম দুর্দশাগ্রস্ত একজন নারীর বিমূর্ত চিত্রের মাধ্যমে জাতির একটি অবয়ব দেখাতে চেয়েছেন তিনি। তার চিত্রটির নান্দনিক নগ্নতা, অশ্লীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। চিত্রটি তার মতে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে না। অতঃপর সুপ্রিমকোর্ট এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল খারিজ করে দেন। কিন্তু আরো তিনটি মামলা তার বিরুদ্ধে জারি থেকে যায় যার একটি ২০০৯ সালে খারিজ হয়ে যায় এবং বাকি দুটি ঝুলে থাকে- সঙ্গে তার চিত্রকর্মের বিরুদ্ধে বর্বরের ন্যায় বিধ্বংসীকারীর ভয়াবহ ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রয়ে যায়। গত বছর তাই ফিদার অ্যাডভোকেট আকিল সিবাল বলেন- ‘‘ভারত সরকার ১৫ বছর ধরে হুসেনের হয়রানির ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে এসেছে। তারা না কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, না হুসেনের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার যেন এভাবে হুসেনের জামিনরূপে না থাকে এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উচ্চ ও তীক্ষ্ণস্বরের বিপরীতে অবশ হয়ে না থাকে।’’ তারপরও সবার নীরবতার ভেতর দিয়েই ফিদাকে ভারত থেকে অনেক দূর অবস্থানে চির বিদায় নিতে হলো।

মকবুল হুসেন ফিদা যিনি মহারাষ্ট্রের পাহাড়পুরে ১৯১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন। তার বাবা  সেখানকার একটি কারখানার শ্রমিকদের কার্যকালের হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। কলেজের গন্ডি পার হয়ে ১৭ বছর বয়সে দর্জির কাজে শিক্ষানবিশী করেন ফিদা। ১৯৩৭ সালে মুম্বাই চলে আসার পর প্রথমে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার বাসনা থাকলেও চিত্রকর্মেই মনোনিবেশ করেন। সেখানে তিনি বিলবোর্ড স্থাপনের সহকারী হিসেবে কাজসহ সাইনবোর্ডের চিত্রশিল্পী হিসেবেও কাজ করেন। তাছাড়া আসবাব এবং খেলনার কারিগর হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন। এর পাশাপাশি চিত্রকর্মের কাজ চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে তার প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বোম্বেতে এবং পরবর্তীতে প্রথম আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী হয় জুরিখে।

তিনি ১৯৫৫ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৭৬-এ পদ্মভূষণ এবং ১৯৯১-এ পদ্মবিভূষণ খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ১৯৭১-এ ব্রাজিলের সাওপাওলোতে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন। শিশুবয়সে মাতৃহীন ফিদাকে আজীবন ‘নারী’র প্রতি এক অসীম সম্মান প্রদর্শন করতে দেখা যায়, নারীকে তাই তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার চিত্রকর্মে ঠাঁই করে দিয়েছিলেন। যে কারণে মাদার তেরেসার ওপর তার সিরিজ চিত্রকর্মে তেরেসার কোন মুখাবয়ব দেখা না গেলেও নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত নারীটিকে আমাদের মাদার তেরেসা বলে শনাক্ত করতে কোন ভুল হয় না। সেই সম্মান থেকেই তিনি ২০০০ সালে নির্মাণ করেন মাধুরি দীক্ষিত অভিনীত ‘গজগামিনী’ চলচ্চিত্র এবং ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন টাবু অভিনীত ‘মিনাক্ষী’ চলচ্চিত্র। ১৯৬০ সালে ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগ তাকে স্বল্প দৈর্ঘের একটি ছবি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করলে তিনি নির্মাণ করেন ‘‘Through the eyes of a painter’’। যে ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয়।

প্রয়াত শান্তি চৌধুরী যিনি ১৯৬০-৭০ দশকের একজন স্বনামধন্য তথ্যচিত্রনির্মাতা হিসেবে খ্যাত, ফিদার ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। যে ছবিতে আমরা ফিদার মহাভারত এবং রামায়ণের প্রতি প্রগাঢ় মনযোগের পরিচয় পাই। ছবিটিতে শান্তি দেখিয়েছেন ফিদার চিত্রকর্মের বেশিরভাগ কাজ মহাভারত এবং হিন্দু মিথ থেকে গ্রহণ করা। ফিদা বিশ্বাস করতেন ধর্মীয় অভিগমন সাংস্কৃতিক প্রতিফলনে তার প্রকাশ ঘটে। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং এই বিশ্বাস সমাজের প্রগতির দিকে ধাবিত করে বলেই তিনি মনে করতেন।

যে শিল্পী তার শিল্পকর্মে সত্যনিষ্ঠ হতে চায় তাকে প্রথমে নিজের কাছে সত্যনিষ্ঠ হতে হয় আর ফিদা ছিলেন এই দুই সমন্বয়ের সংশ্লেষণ। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী এই শিল্পী কোন দামি রেস্তোরাঁর চেয়ে রাস্তার ধারের দোকানের চা-ই বেশি পছন্দ করতেন। এই সাধারণত্বের কারণেই  তিনি তার শিল্পকর্মে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য তথা মূল সংস্কৃতির সন্ধানে রত ছিলেন। তার এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে ’৯৬-এ আহমেদাবাদ গ্যালারিতে তার চিত্রকর্মের ওপর আক্রমণের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন- ‘‘আন্তর্জাতিক শিল্পী হতে হলে নিজের শেকড়কে কখনো অস্বীকার করা যায় না। …আমি ভারতের একটি অংশ, আমার আছে ৫০০০ বছরের সংস্কৃতি এবং ভারতে জন্মে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি।’’ তার মৃত্যুর পর স্বভাবতই এখন প্রশ্ন জাগবে, তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলেও ভারত তার প্রতিদানে তাকে কতটুকু ভাগ্যবান মনে করে বা করবে? কারণ ফিদার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যে শিল্পীকে নিজের দেশে বিড়ম্বনার কারণে শেষ বয়সে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হয়, মৃত্যুর পরও কি সেই শিল্পী সেই দেশের (কাতার) নাগরিক হয়েই থাকবেন?

সুনীল শেঠি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তার প্রবন্ধ ‘A Portrait of India’s Intolerance’-এ তাই লিখেছেন, ‘‘ভারত হয়তো এখন হুসেনকে তার দেশের সন্তান হিসেবে দাবি করবে। কেউ কেউ তার নামে ডাকটিকিট ছাপাবে। অন্যরা তার নামে রাস্তা বা গ্যালারির নামকরণ করবে…।’’ এসবের পরেও ভারতের শিল্পকলার ইতিহাসে ফিদার উদাহরণ একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যে দৃষ্টান্ত অন্য শিল্পীদেরও ভাবিয়ে তুলছে। মুম্বাই থেকে অনুপমা কাটানাম তার একটি হ্যান্ডআউট (M.F. Hussain remained a victim of attacks and hate campaingns by Hindutva groups in the last 15 years) এ লিখেছেন- ‘‘…ফিদার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ‘শিল্পের স্বাধীনতা’র প্রশ্নটি আবার নবরূপে দেখা দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যর্থতার প্রশ্নটিও উত্থাপিত হচ্ছে। হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর পরমত অসহিষ্ণুতার প্রথম শিকার চিত্রকর হুসেন। যথেষ্ট ক্ষতি তার করা হয়েছে। অনেক শিল্পী এখন সৃষ্টিশীল কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন। হুসেনের পথে যেতে এখন সবাই ভয় পাচ্ছেন…।’’সেজন্যই সুন্দরের সাধনা দিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করা হয়েছিল। শিল্পের কাজ সুন্দরের সাধনা অর্থাৎ আনন্দ প্রদান, রাষ্ট্র বা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তার বা তাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো শিল্পের কাজ বন্ধ করে দিলে তাতে  সেই রাষ্ট্রেরই শুধু ক্ষতি হয় না, সেই সঙ্গে গোটা মানবসমাজেরও ক্ষতি হয়। আমরা কোনো দেশের জন্যই সেই ক্ষতি ভবিষ্যতে দেখতে চাই না।
ফ্লোরা সরকার