মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১১

তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর : এই অকাল মৃত্যু অনিবার্য নয়

বাংলাদেশ শুধু আর্থিক দিক থেকে নয়, বুদ্ধিজীবিতার দিক থেকেও দরিদ্র। এখানে শিক্ষিতের হার শুধু স্বল্প নয়, উচ্চশিক্ষিতের হার আরো স্বল্প। শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই দারিদ্রে্যর চেহারা আরো প্রকট। বিশেষত চলচ্চিত্র শিল্পে হাতে গোনা কয়েকজন চিত্র পরিচালকের দেখা-সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে সত্তরের দশকে যখন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প মাত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখন আমরা জহির রায়হানের মতো চিত্র পরিচালককে অকালে হারাই। আশির দশকে এদেশের চলচ্চিত্র যখন নান্দনিক, বস্ত্তনিষ্ঠ ও সুস্থধারার চলচ্চিত্রের মুখ দেখতে শুরু করে আলমগীর কবীর, কবীর আনোয়ার, সালাউদ্দিন জাকি, মশিউদ্দিন শাকেরের মতো উঁচুমাপের নির্মাতাদের হাত ধরে, ঠিক সেই সময়ে আমরা হারাই আলমগীর কবীরকে। আলমগীর কবীরের হাত ধরে সেই সময়ে কিছু তরুণ চলচ্চিত্র শিল্পে এগিয়ে আসেন যারা পরবর্তীতে আমাদের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তারেক মাসুদ ছিলেন সেই বিরল প্রতিভাবানদের একজন। চলচ্চিত্র যার কাছে ছিল স্বপ্ন এবং বাস্তব, দু-ই। চলচ্চিত্র শিল্পে নির্মাতাদের পাশাপাশি আমাদের এখানে সিনেমেটোগ্রাফার বা দক্ষ চিত্রগ্রাহক খুব বেশি নেই। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুত্র মিশুক মুনীর যার পুরো নাম আশফাক মুনীর চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল চিত্রগ্রাহকদের একজন। গত ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের অকাল প্রয়াণ ঘটে। কাকতালীয় হলেও আলমগীর-কবীরেরও প্রয়ান ঘটে গাড়ি দুর্ঘটনায়। তিনি মারা যান ফেরীতে উঠতে গিয়ে গাড়িসহ সলিল সমাধি হয়ে।
বর্তমান এই সময়ে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রকট দুর্দিন চলছে। অনেক সিনেমা হল ইতোমধ্যে মার্কেটে রূপান্তরিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আরো বেশকিছু হল বন্ধ হওয়ার প্রহর গুনছে। দেশে ভালো ছবির অভাবে বিদেশ বিশেষত ভারত থেকে ছবি আমদানির ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়ে গেছে। আগামী ঈদ থেকে আমাদের সিনেমা হলগুলোতে এসব ছবির প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা। চলচ্চিত্র শিল্পের এই দুর্যোগকালে এই দুজন প্রতিভাবানের অকাল প্রয়াণ আমাদের জন্য কতটা ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ তা বিশেষ কোনো ব্যাখ্যার দাবি রাখে না। ক্ষতিটা ‘অপূরণ’-যোগ্য, কারণ বিরল প্রতিভার আগমন খুব সহজে ঘটে না।
তাদের কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্তসার : আশির দশকে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে ‘বিকল্পধারা’ আন্দোলনে যারা প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নির্মাতা তারেক মাসুদ ছিলেন তাদের পুরোধাদের একজন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন আর তা হলো, আমাদের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র কখনো মূল বা প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্রের (এফডিসিকেন্দ্রিক প্রযোজকদের পুঁজি ও সেখানকার কারিগরি সুবিধা ব্যবহার করে এবং এই ধারায় প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা এবং তারকাদের নিয়ে যেসব ছবি নির্মিত হয়) প্রতিপক্ষ ছিল না। যে কারণে তারেক মাসুদ কখনোই বিকল্পধারা এবং বাণিজ্যিক ধারায় চলচ্চিত্রকে বিভাজিত করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক সিনেমার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে সিনেমা জগতে যে বিকল্পধারা ‘দ্য নিউ আমেরিকান সিনেমা’য় দেখা যায়, আমাদের বিকল্পধারা তার থেকে বেশ ভিন্ন। মূলত ১৬ মিলিমিটার ফরম্যাটকে ৩৫ মিলিমিটার ফরম্যাটের বিকল্প বা সমান্তরাল সিনেমা হিসেবে উপস্থাপন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমস্যাবলীর সমাধান, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিকল্প নেটওয়ার্ক নির্মাণ, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও প্রদর্শন প্রক্রিয়ার গণমুখী এবং প্রগতিশীল চরিত্র সংরক্ষণ, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনসমূহ রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও একাত্মতা, সর্বপ্রকার সামাজিক অবিচারবিরোধী সংগ্রাম এবং মৌলবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা – এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমাদের এখানে বিকল্পধারার আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যেজন্য তারেক মাসুদকে আমরা দেখি শহর থেকে গ্রামে আমাদের চলচ্চিত্রকে নিয়ে যাননি বরং গ্রাম থেকে চলচ্চিত্রকে তিনি শহরে নিয়ে আসেন।
কোনো ছবি নির্মিত হওয়ার পর, তা শুধু শহরের প্রেক্ষাগৃহে বন্দি হয়ে থাকেনি, ছবি নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত এলাকায়। আবার ঠিক একইভাবে তা চলে গেছে দেশের বাইরের সব প্রেক্ষাগৃহে। আমাদের চলচ্চিত্রকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তার ঘটানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন দশটা বিবৃতি বা বক্তৃতায় যা হয় না তা একটিমাত্র চলচ্চিত্র দিয়ে হতে পারে। আর তাই সারাজীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন একজন সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং সফল চিত্রনির্মাতা হিসেবে। ‘সোনার বেরি’ (১৯৮৫) দিয়ে তার চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটলেও ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫) এবং ‘মাটির ময়না’ (২০০২)র মধ্যে দিয়ে তার দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার যাত্রা শুরু হয়। মুক্তির গানকে ১৯৯৭ সালে ফিল্ম সাউথ এশিয়া থেকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। যৌথভাবে তারেক মাসুদ এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত ডকুমেন্টারি ছবিটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দলিল হিসেবে আমাদের মাঝে থাকবে। ছবিটির ফুটেজ মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন, যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের লক্ষ্যে সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শেষ করতে পারেননি, মাসুদ তার কাছ থেকে সেসব ফুটেজ এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত উপাদান যোগ করে নির্মাণ করেন ছবিটি।
মুক্তির গানের পর ‘মুক্তির কথা’ নির্মাণ করেন ১৯৯৬-এ, যে ছবি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘মাটির ময়না’ ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত কাহিনী চিত্র যার সমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাশাপাশি আনুর মাদ্রাসার চরম ও মধ্যপন্থী মতবাদের বিকাশ এবং সেইসঙ্গে আনুর বাবা-মায়ের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও স্বাধীনতার চেতনার চিত্রের সমান্তরাল ছবি চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পরিচালক মাত্র দুটি সংলাপের মাধ্যমে দর্শককে বুঝিয়ে দেন, ভাষার বিষয়ে আমাদের মূল বিরোধ আরবি নয় উর্দুর সঙ্গে ছিল। একটি দৃশ্যে আমরা দেখি আনুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যে চরিত্রটি ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও বটে, তাকে মাদ্রাসার শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন সে উর্দুতে এত কাঁচা কেন, ছেলেটি উত্তরে বলে, উর্দুর চেয়ে তার আরবি পড়তে বেশি ভালো লাগে। এভাবে পরিচালক আমাদের বিরোধের জায়গাটা স্পষ্ট করে দেন। ছবিটি ২০০২ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড ও ডিরেক্টর ফর ফোর্টনাইট পুরস্কারে ভূষিত হয়। একই বছরে এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালসহ আরো অনেক ফেস্টিভালে দেখানো হয় এবং পুরস্কৃত হয়।
২০০৬-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্তর্যাত্রা’য় আমরা দেখি, স্বদেশভূমে শেকড়ের সন্ধানে আসা মা ও ছেলের এই যাত্রা তাদের অন্তর্যাত্রা হয়ে যায় কীভাবে। তার অপর একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’। যে ছবি আমাদের বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতানকে নিয়ে চিত্রিত, সেই ছবি দেখে সুলতান এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তিনি পরিচালককে বলতে বাধ্য হন – ‘সাধারণভাবে বিখ্যাত মানুষের তথ্য বা প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে পরিচালক বিখ্যাত হন আর এই ছবিতে ঠিক উল্টোটা হয়েছে।’ অর্থাৎ তারেক মাসুদের মাধ্যমে সুলতান বিখ্যাত হন। প্রকৃতপক্ষে একজন প্রতিভাধর অপর একজন প্রতিভাধরকে শনাক্ত করতে কখনো ভুল করেন না, পরিচালকেরও তাই ভুল হয়নি চিত্রকরকে শনাক্ত করতে।
তারেক মাসুদের কাজের ভেতর সব থেকে যে বড় অংশটি জুড়ে ছিল তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি। আর দশজন সাধারণ মানুষের থেকে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তার কাছে ১৯৭১ সালে বাস্তবে কী ঘটেছে তার থেকে অনেক বড় বিষয় ছিল কে কোন পারসেপশন বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখে। কেননা, দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যে কোনো আখ্যান-উপাখ্যান গড়ে ওঠে। তার একটি লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের বিতর্কিত ছবি’তে তিনি লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রধান অংশ হলো, মানুষ মানুষকে মেরেছে। কিন্তু এটাও পরম সত্য, একাত্তরে মানুষ মানুষকে বাঁচিয়েছে। একজন বিহারিকে বাঙালি বাঁচিয়েছে, একজন বাঙালিকে বিহারি বাঁচিয়েছে। একজন বাঙালি একজন নিরস্ত্র বন্দি পাকিস্তানি সৈন্যকে বাঁচিয়েছে। একজন পাকিস্তানি একজন বাঙালিকে বাঁচিয়েছে। এই বহুমাত্রিক দিকটি কিন্তু সাধারণত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে প্রথম পর্যায়ে খুব একটা দেখি না।’ দেখার এই বহুমাত্রিকতা আমরা খুব কম চিত্রনির্মাতার মাঝে পাই। আর তাই তার পরবর্তী ছবি ‘নরসুন্দর’ (২০০৯) মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হওয়া সত্ত্বেও, ছবিতে দেখি আবাঙালি হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ায় সেই নরসুন্দর। ছবির নামের সঙ্গেও চমৎকার সামঞ্জ্যতা পাই কাহিনীর। ‘রানওয়ে’ (ছবিটির প্রিমিয়ার হয় ২ অক্টোবর, ২০১০) ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের সমাজবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এই সমাজের প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এর বিষয়বস্ত্ত। যার অসাধারণ চিত্রগ্রহণ আমরা পাই মিশুক মুনীরের মুন্সিয়ানায়।
পিতার উপযুক্ত সন্তান হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন মিশুক মুনীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। তবে পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার চেয়ে ক্যামেরা হাতে নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসতেন। ক্যামেরার ভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করতেন। দেশে যখন ইলেট্রনিক্স মিডিয়ার বিকাশ ঘটেনি তখনো তিনি ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বাইরে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যানেলের হয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য।
একুশে টিভির যাত্রারম্ভে মিশুক মুনীর দায়িত্ব পান সংবাদ বিভাগ পরিচালনার। হলিউডসহ কানাডার রিয়ের নিউজ নেটওয়ার্কের মতো জায়গায় কাজ করা সত্ত্বেও দেশের টানে ফিরে এসে যোগদান করেন এটিএন নিউজে। কর্মপাগল মানুষটি শুধু খবরের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। ক্যামেরা হাতে ছুটে গেছেন বিভিন্ন ছবি নির্মাণের কাজে। তারেক মাসুদের ছবিতে আমরা পাই তার অনবদ্য ক্যামেরার কাজ। দুজন যেন মানিকজোড় হয়ে কাজ করেছেন ছবির ক্ষেত্রে। তারেক মাসুদের নরসুন্দর এবং রানওয়ে ছবির চিত্রগ্রহণ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ অথচ পরিপূর্ণ আনন্দ প্রদান করে দর্শকদের। তারেক মাসুদের সর্বশেষ ছবি ‘রানওয়ে’তে ক্যামেরা যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় দর্শকের কাছে। মনে হয় রানওয়েতে বসে খুব কাছে থেকে আমরা বিমান উড়তে দেখি, যে বিমান অন্যতম একটি প্রতীক হয়ে দেখা দেয় ছবিতে।
নতুন নতুন উদ্ভাবনের নেশায় মেতে থাকতেন এই দক্ষ মানুষটি (মিশুক-মুনীর)। বন্যপশু সংরক্ষণে ছিল তার প্রগাঢ় আগ্রহ। পশুর প্রতি এই অসীম ভালোবাসা, যা খুব বিরল আমাদের মাঝে। ক্যামেরার পশ্চাতে যারা থাকেন তাদের পরিচয় আমরা খুব একটা পাই না। তাছাড়া মিশুক মুনীর ছিলেন প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। সত্যিকার কাজে যারা নিজেদের নিয়োজিত রাখেন প্রচারের প্রচারণা তাদের কখনো প্ররোচিত করে না। আর তাই তার মৃত্যুর পরই শুধু তার কর্মসফল জীবনের পরিচয় আমরা পেলাম। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে তার মৃত্যুর পর একটি আলোচনার টেবিলে সম্পাদক আবেদ খান তার সম্পর্কে চমৎকার একটি কথা আমাদের জানালেন- ‘একদিন আমি মিশুককে বললাম, এত রাত পর্যন্ত কাজ করছ, তুমি কি বাড়ি যাবে না? মিশুক উত্তরে বললেন- ‘আমি তো বাড়িতেই আছি’। যে মানুষ কর্মস্থল এবং গৃহস্থলের মাঝে কোনো বিভেদ টানেন না, তিনি কত বড় কর্মী হতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এতবড় কর্মীকে আমরা হারালাম। আমরা বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ কত শক্তিমান একজন প্রতিভাধর চিত্রগ্রাহককে হারাল। এই হারানোর বেদনার ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা আমাদের নেই। শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারি মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদের মতো বিরল প্রতিভা এদেশে আমরা খুব একটা পাই না। হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মে আমরা পাব। কিন্তু এরকম প্রতিভার সন্ধান পেতে আমাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
শুরু করেছিলাম দারিদ্র্য দিয়ে। আমাদের বিত্তের দারিদ্র্য যাই থাক, আমাদের চিত্তের দরিদ্রতা যেন আমাদের গ্রাস না করে ফেলে। বিশেষত মিডিয়ার মতো শক্তিশালী একটি মাধ্যম, যে মাধ্যম একমুহূর্তে অনেক মানুষের কাছে চলে যেতে পারে সেরকম জায়গায় তাদের মতো মানুষ এখন আমাদের খুব প্রয়োজন। তাদের প্রতি শুধু শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব শেষ করে না দেই। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো মানুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই হবে তাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তারা তাদের কাজের মাঝে যে নিষ্ঠা, সততা, শ্রম আর কর্মদক্ষতা আমাদের দেখিয়েছেন তা ভুলে গেলে তাদেরও অসম্মান করা হবে। বিশেষত চলচ্চিত্র, নাটকের এই দুর্যোগের সময়ে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো মানুষের কত প্রয়োজন চলচ্চিত্র এবং মিডিয়া কর্মীরা তা উপলব্ধি করতে পারবেন সব থেকে অধিক। আমরা আশা করব, আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভাবানরা যেন এভাবে অকালে চলে না যান। যে মৃত্যু তারেক মাসুদকে তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের ছবি ‘কাগজের ফুল’কে আর ফুটতে দিল না। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু অকাল মৃত্যু অনিবার্য নয়। যে মৃত্যু মানুষের হাতে তা হতে দেওয়া যায় না। আর তাই সড়ক দুর্ঘটনা নয়, সড়ক সন্ত্রাসে যেন আর কোনো হত্যা সংঘটিত না হয়।
ফ্লোরা সরকার