শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

ফকির লালন শাহকে ‘বর্তমান’ করে তোলা --ফরহাদ মজহার

বাজার ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য হয়ে ওঠে,  লালন ব্যতিক্রম কেউ নন। ফলে লালন সাধক ছিলেন বলে তাকে নিয়ে সিডি, ভিডিও বা সিনেমার ব্যবসা হবে না, এই গ্যারাণ্টি দেওয়া কঠিন। তাকে নিয়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। লালন সাঁইজীকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা করেন অনেকে। অভিযোগ ওঠে লালন কর্পোরেট বাণিজ্যের বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। আপত্তিকর মনে হয়। আপত্তি ওঠা স্বাভাবিক। ফলে ফকির লালন শাহকে বাজারের দূষণ থেকে বিশুদ্ধ রাখার একটা বাসনা ও চেষ্টা দানা বেঁধে উঠতেই পারে। লালন নিয়ে একটা বাজারি আগ্রহ যেমন তৈরী হয়েছে, ঠিক তেমনি একটা উদ্বিগ্নতাও আছে।
সামনে পহেলা কার্তিকে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস আসছে। ভাবছি, লালন যখন তিরোহিত, তিনি যখন জীবদেহে স্বয়ং হাজির নাই, তখন তাঁর ডাকনাম কেন্দ্র করে বাংলার ভাবান্দোলনের অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। লালনকে নানান দূষণ থেকে রক্ষা রেখে বিশুদ্ধ রাখার বাসনার প্রসঙ্গ টানছি আলোচনায় সহজে প্রবেশ করবার জন্য।

বাংলা ১২৯৭ সালে (খ্রিস্টিয় ১৮৯০) তাঁর তিরোধানের পর ১২১ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই দিনে কুষ্টিয়ার ছেঁঊড়িয়ায় তাঁর ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা ছোটখাট যে অনুষ্ঠান করতেন সেটা এখন লালন একাডেমির সরকারী অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তিরোধানের দিন তো শোকের দিন। কিন্তু এখন সেটা আর শোকের দিন হিশাবে নয়, রীতিমতো উৎসব হিশাবে পালন করা হয়। এছাড়া ফকির লালন শাহ জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় যে ‘সাধুসঙ্গ’ করতেন সেই দিনটি সাধুগুরুরা সাধুসঙ্গ হিশাবেই পালন করে আসছিলেন। কিন্তু সেটাও এখন একটা মেলায় পরিণত হয়েছে। লালন একাডেমি দোলপূর্ণিমাতেও সরকারী ভাবে মেলা বসান। সাধুগুরুদের এখন কমই দেখি। পনের বিশ বছর আগেও ছোট ছোট দলে বিভিন্ন জায়গায় রাতভর গান আর তত্ত্বালোচনা দেখেছি। এখন হল্লা বেড়েছে। সাধুগুরুদের আগমন কমেছে। এলেও তাঁরা একদিন এক রাত থেকে চলে যেতে দেখি। তত্ত্বালোচনা একদমই হয় না, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু তার মগ্নতা ও গভীরতা কমেছে, অন্যদিকে সেটা ক্রমাগত চাপা পড়ে যাচ্ছে কোলাহলে।

গত কয়েক দশকে নিজের চোখের সামনেই ছেঁঊড়িয়াকে বদলে যেতে দেখেছি। একই সঙ্গে দেখেছি লালনপন্থী সাধুগুরুদের মধ্যেও লালন চর্চার রূপান্তর। যে জীবন চর্চা আগে সম্ভব ছিল, গ্রামে সেই জীবন ধারণ এখন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চর্চাও বৈষয়িক কারণে বদলে যাচ্ছে। লালনের গান চর্চার মধ্যেও রূপান্তর ঘটেছে। আগে শিল্পী গড়ে উঠত বিভিন্ন সাধুসঙ্গে গান গেয়ে এই ভাবের পরিমন্ডলে পরীক্ষা দিয়ে। এখন তারা উঠে আসতে চায় ‘বাংলাদেশ তোমাকে খুঁজছে’ ধরনের অনুষ্ঠানের বিচারকদের সন্তুষ্ট করে। শিল্পীর খ্যাতি বা সাফল্য লালনপন্থী সাধুগুরুদের সন্তুষ্টি অর্জনের ওপর আর নির্ভরশীল নয়। লালনের গানের সঙ্গে  আর লালনের জীবন ও ভাবচর্চার একটা বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে সাধকের জীবন চর্চা থেকে আলাদা করে যে ছেদটা টানা হয়েছিল সেটা এখন পূর্ণ বিচ্ছেদে পরিণত হয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে একটা গানের ঘরানা তৈরী হয়েছে যার সঙ্গে সাধক জীবনের কোন সম্পর্ক নাই। ব্যান্ড শিল্পীরাও লালন গাইছেন। নাচাকুঁদা করছেন। নতুন মাধ্যম নতুন যে শ্রোতা শ্রেণী তৈরী করেছে তাদের মনোরঞ্জনের ওপর সেই গীতির গায়কী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সাধুসঙ্গে যে গান ভাবচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে নিজের বিকাশ ঘটাত, সেই চর্চার পরিমন্ডল থেকে গান আলাদা হয়ে গিয়েছে। আজকাল আবার ছেঁউড়িয়ায় দেখি হিন্দি গানের সুরে লালনের গান সুর করবার চেষ্টা। মোট কথা, পুরানা সম্পর্ক পুরানা প্রতিষ্ঠানগুলো সব ভেঙ্গে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে।  শ্রুতি ও কণ্ঠনির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে ভাবচর্চার যে ধারা এতোকাল বিকশিত হতে পেরেছে, অক্ষর, মূদ্রাযন্ত্র বা ডিজিটাল যুগে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা কঠিন। সেটা আদৌ সম্ভব কিনা, কিম্বা সম্ভব হলে তার চর্চার রূপ কেমন হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার মীমাংসা হয় নি।

বাজার এখন সর্বব্যাপী, পুঁজিই এই যুগে ধর্ম। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফকির লালন শাহের একটা বদল ঘটবে। ঘটছেও। কিন্তু সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া তীব্র হবার কারণেই ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে  কথাটা পুরাপুরি সত্য নয়। বাজার ব্যবস্থা সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার আগেও বদল ঘটছিল। যদি রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখি তাহলে দেখব লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মতিজান-লালনের কবর ও স্মৃতিক্ষেত্র থেকে ফকিরদের উৎখাত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে। গুরুবাদী ফকির লালন শাহ কবর পূজারি ছিলেন না। কিন্তু যেখানে তিনি দেহ রেখেছেন সেটা এখন ‘মাজার’ হয়ে গিয়েছে। এখন দেখি আরবি লেখা গিলাফ দিয়ে মতিজান ও তাঁর সমাধিও মাঝে মধ্যে ঢাকা হয়। লালনের জীবদ্দশায় মলম শাহের যে বাড়ি তাঁর আখড়া ছিল সেখানে তার চর্চার ধারা আর তাঁর তিরোধানের পরে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে চর্চার ধারার মধ্যেও ছেদ পড়েছিল। তাঁর দুই শিষ্য মনিরুদ্দিন ও ভোলাই শাহের মধ্যে মতপার্থক্য ও আখড়ার মালিকানা নিয়া ঝগড়াবিবাদের ইতিহাস আমাদের জানা। ফকির লালন শাহের নামে তার শিষ্যরা যা টিকিয়ে রেখেছেন তাদের প্রত্যেকে ফকির লালন শাহকে যে যেমন বুঝেছেন তেমনি চর্চা করেছেন। তাঁরাও তাদের মত করেই বাংলার সাধনা বা ভাবচর্চার ধারায় অবদান রেখেছেন। অর্থাৎ লালনের শিষ্যদের মধ্য দিয়ে লালনের বিশুদ্ধ কোন ধারা বহাল থাকে নি। এই বিশুদ্ধতার অনুমানে ফকির লালন শাহ নিজেও সায় দিতেন না। আখেরি নবী সম্পর্কে তাঁর নিজের একটা গান রয়েছে এই রকম:

নবির সঙ্গে ছিল ইয়ার চারজন

চারকে দিলেন নবি চারমত যাজন

নবি বিনে পথে গোল হোল চার মতে

ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে।।

নবির চার সাহাবাকে নবী চার রকম যাজন বা শিক্ষা দিয়েছিলেন। নবির তত্রোধানের পর চারজন চার ভাবে নবিকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গোলমালে পড়া যাবে না। এটা তো ফকির লালন শাহ সম্পর্কেও সত্য। তার তিরোধানের পর তাঁর শিষ্যরা যে যেমন বুঝেছেন তেমনি করেই লালনকে ব্যাখ্যা করবেন, তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশাবলী চর্চা করবেন, এটাই হবার কথা। তেমনি করেই তারা চর্চা করেছেন। যতটুকু তাঁরা বুঝেছেন ততোটুকুই তাঁরা তাঁদের জীবনে ফকির লালন শাহকে ‘বর্তমান’ করে তুলেছেন। ফকির লালন শাহের এখন যে খ্যাতি বা পরিচিতি সেটা তাঁর শিষ্যদের জীবন ও ভাবচর্চার খ্যাতি নয়। লালনের খ্যাতির জন্য তাঁর গানের ভূমিকা মুখ্য। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও কথা আছে। লালনের গান এর আগে খোদা বক্স, মকসেদ আলীসহ আরো অনেকে গেয়েছেন। তাদের একটা পরিচিতিও রয়েছে। লালনকে জীইয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁরা বিশেষ কোন আবেদন তৈরী করতে পারে নি। এমনকি আবদুল আলিম যখন লালনের গান বেতারে গাইলেন এবং তুলনামূলক ভাবে অধিক জনপ্রিয় করলেন তখন সেই গানগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী ‘পল্লীগীতি’ হিশাবেই শুনেছে। পল্লীগীতি হিশাবেই কিছু শ্রোতা আবদুল আলিম তৈরী করতে পেরেছিলেন। যেমন, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’, ‘চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি’, ‘এই দেশেতে এই সুখ হোল’ ইত্যাদি গান তার মারফত পল্লীগীতি হিশাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ‘লালনগীতি’ নিজের পরিচিতি নিয়ে হাজির হওয়া শুরু করে স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভিনের গলা ও গায়কী ধরে। স্বাধীনতা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে নতুন আগ্রহ তৈরী করবার কারনে এটা ঘটেছে, নাকি এই সময় টেপ ও ক্যাসেট রেকর্ডার ভূমিকা রেখেছে সেটা নির্ণয় করা গবেষণার বিষয়।

এই দিকগুলো মনে রাখলে লালনকে বিশুদ্ধ রাখার চিন্তার মুশকিল আমরা ধরতে পারব। আসলে ফকির লালন শাহ তাঁর গানের জন্য যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন সাধক ও ভাবুক হিশাবে প্রতিষ্ঠা পান নি বললেই চলে। এই অভাবের কথা মনে রেখেই প্রশ্ন তোলা যায় ফকির লালন শাহকে কেন্দ্র করে বাংলার ভাবান্দোলনের যে-চর্চা এখন জারি আছে, তার অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। সোজা কথায় লালনকে কিভাবে বুঝলে ও চর্চা করলে তিনি এই কালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন?

[দুই]

শুরুতেই বলা যায় ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা রক্ষার বাসনা শেষাবধি প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয় কিম্বা পর্যবসিত হবার বিপদে পড়ে। এই বাসনা ত্যাগ করা দরকার। লালন যখন জীবিত ছিলেন তখনও তাঁকে কিম্বা তার চর্চা ও গানকে বিভিন্ন জাত ও শ্রেণী নিজের নিজের জায়গা থেকেই ব্যাখ্যা করেছে। লিঙ্গভেদে লালনের তাৎপর্যও ভিন্ন হয়েছে। তাহলে বিশুদ্ধ লালনকে খুঁজব কোথায়? অর্থাৎ জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদের দিক থেকে বিভিন্ন লালন তো আছেই তার ওপর বাজার লালনের যে ভূত নির্মাণ করে সেটা যেমন আপত্তির, ঠিক একই ভাবে তার বিপরীতে লালনকে ‘বিশুদ্ধ’ ভাবে পাঠ ও হাজির করবার বাসনাও সমান মুশকিলের।

তবে লালনকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা মাত্রই নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক বিরোধিতার বাসনা ভিন্ন। সেই বাসনাকে বিশুদ্ধ লালন সন্ধানের আকুতির মধ্যে চেনা যাবে না। বরং তার আকুতি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনার মধ্যে। এই বাসনার চরিত্র রাজনৈতিক হতে বাধ্য। সেই বাসনার দিক থেকে দেখলে বাংলার ভাবচর্চার দরকারি অভিমুখটা শনাক্ত করা সহজ হয়। এই পথেই লালনকে বর্তমান করে তুলবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই অভিমুখটা স্পষ্ট হলে ফকির লালন শাহ জীবনযাপন ও ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে যে-জগতটা তৈরী করবার সাধনা করেছেন তাকে চেনা, জানা ও বোঝার চেষ্টা অনেক বেশী ফলপ্রসূ হতে পারে। নইলে ফকির লালন শাহ এবং তার অনুসারী ও অনুরাগীরা বড়জোর নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবেন; বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রান্তিক অনুষঙ্গ হিশাবে থাকবেন তারা। বাউল ফকির হিশাবে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে তাদের অন্তর্গত করে নেবার জন্য যেটা দরকার। এর অধিক কিছু হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনা থেকে কাজ করা না হলে এখনকার লড়াই সংগ্রামে ফকির লালন শাহ প্রাসঙ্গিক হবেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে তোলাকেই আমরা তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলা বলছি।

কিভাবে এই অভিমুখটা নির্দিষ্ট করা যায় সেই বিষয়ে দুই একটি প্রস্তাব দেবার জন্যই এই লেখা। প্রথমেই যে দিকটা স্পষ্ট করা দরকার সেটা হোল আমাদের কিছু অভ্যাস বদলানো জরুরী। ফকির লালন শাহকে মরমি বা আধ্যাত্মিক পুরুষ হিশাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত; এই অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। লালন বেদকোরান শাস্ত্রকথা বা কোন কানকথা বা লিখিত কথাকে আক্ষরিক সত্য বলে মেনে নেন নি। আমরা জগতকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করতে অভ্যস্ত। এই অভ্যাসের জায়গা থেকে লালনকে বোঝা কঠিন। লালন মানুষের ভজনা করেছেন। সেখানে ইহলোক/পরলোক ভেদ নাই, দেহ ও আত্মার বিভাজন নাই। আমরা যেহেতু আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে ভাবতে অভ্যস্ত, ফলে দেহসাধনার কথা শুনলে আমরা তাকে দৈহিকতা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। এই দৈহিকতার মানেও আমাদের কাছে হয়ে ওঠে যৌনতার চর্চা। এর ফলে দেহের বাইরে যে আসলে ‘মানুষ’ নামক বিমূর্ত কিছু নাই, এই অতি প্রাথমিক ‘বস্তুবাদী’ শিক্ষা আমাদের নজরের আড়ালে চলে যায়। তখন লালনকে বুঝতে গিয়ে আমরা নানান গুহ্য সাধন প্রণালী, চারিচন্দ্র ভেদ ও নানান আচার-অনুষ্ঠানকে মুখ্য জ্ঞান করা শুরু করি। যেহেতু গোপন ও রহস্যময় জগতের দিকে মানুষের একটা স্বাভাবিক কৌতূহল থাকে, তখন গোপন যৌনচর্চার আলোকে লালনকে এক রহস্যময় পুরুষ হিশাবে গড়ে তোলা হয়। এর পরিণতি কি হতে পারে সেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস ও সেই  উপন্যাস নিয়ে গৌতম ঘোষের বানানো ছবির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে লালন চন্দ্র কর নামে এক চরিত্র বানানো হয়েছে যে রীতিমত রতিগ্রস্ত। তার গুরু তাকে মেয়ে সাপ্লাই দেয়। যৌনতার চর্চা ছাড়া তার অন্য কোন সাধনা নাই। নারী যার কাছে নিছকই সাধনার উপায় বা তথাকথিত ‘সাধনসঙ্গিনী’।  সেখানে লালন এমনই এক ব্যক্তি যে কোন চিন্তা করতে জানে না, গান বা বাক্য তার মধ্যে আপনা আপনি আসে, আপনা আপনি পয়দা হয়। ইত্যাদি।

ওপরে ‘বস্তুবাদী’’ কথাটা উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছি এ কারণে যে বস্তু ও ভাবের বিভাজন মেনে ‘বস্তুবাদ’’ ও ‘ভাববাদ’ হিশাবে যেভাবে আমরা চিন্তাকে পরস্পর বিরোধী গ্রোতে বিভক্ত করি, লালনকে বুঝতে হলে এই বিভাজনের ফাঁদে পা দিলে চলে না। দুইয়ে দুইয়ে জগতকে বিভক্ত করে ভাববার অভ্যাস ত্যাগ করার দিক থেকে থেকে আমরা লালনকে ‘বর্তমান’ করে তোলার অভিমুখ নির্দিষ্ট করবার প্রথম সূত্রটা তাহলে আমরা এখানে পাচ্ছি।

দ্বিতীয়ত বাংলার ভাবান্দোলনের জাতপাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী যে রাজনৈতিক ধারা শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের আমল থেকে শুরু হয়েছিল ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ও বিকাশ নদিয়ার সেই ভাবের মধ্যেই। এই রাজনীতিই লালনের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তুলেছে। জাতপাতবিরোধী নদিয়ার এই ভাবের বিকাশের ক্ষেত্রে ফকির লালন শাহের গুরুত্ব অপরিসীম। এর রাজনৈতিক দিকটা বোঝার জন্য শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসটা আমাদের জানা দরকার এবং সেই প্রয়োজনে সুলতানি আমল ও ইসলামের ভূমিকা বোঝা জরুরী। এই ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে খুবই কম, যদিও সম্প্রতি কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে।

যে ভাবগত জায়গায় দাঁড়িয়ে ফকির লালন শাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও ভেদবুদ্ধির রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন তাকে বিশেষ ভাবে বোঝা দরকার। সেই ক্ষেত্রে তাঁর ভাবুকতা ও রাজনীতিকে আমরা আলাদা করতে পারি না। মানুষের ভজনা করেছেন তিনি, কিন্তু মানুষে মানুষে সমান এই বুর্জোয়া সাম্যবাদ ফকির লালন শাহ প্রচার করেন নি। তার মধ্যে এই প্রকার কোন ‘মানবতাবাদ’ নাই। তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরোধিতার যুক্তিটা তিনি কিভাবে খাড়া করেছেন? তাঁর যুক্তি হচ্ছে, ‘‘ব্রাহ্মণ, চন্ডাল, চামার, মুচি সকলেই এক জলে সূচি’’। সকলেরই সূচনা ‘‘একই জল’’। রজোবীজের প্রাকৃতিকতায় সকল মানুষের সূচনা ঘটেছে ‘‘একই জলে’’। মানুষের মধ্য দিয়েই মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতি, প্রক্রিয়া বা প্রাকৃতিকতার দিক থেকে অভেদ প্রতিষ্ঠার এই বিশিষ্টতার দিকে নজর রাখা দরকার। ‘দেহ’ কেন বাংলার ভাবান্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয় সেটা আমরা এই ক্ষেত্রেও দেখছি।

তৃতীয় দিকটা হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র প্রশ্ন। যে-জীবন সাধকরা চর্চা করেছেন সেখানে ত্যাগের ভূমিকা প্রধান, এটা সহজেই বোঝা যায়। সম্পত্তি বা বিষয়আশয় ত্যাগের দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়-আশয় ত্যাগ করতে গিয়ে ফকির লালন শাহ ‘বর্তমান’-কে ত্যাগ করেন নি। বাস্তব জগতকে ত্যাগ করবার কথা বলেন নি। এখানে শিক্ষণীয় দিকটা হচ্ছে বিপ্লব বা আইন করে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করলে সেটা উৎখাত হয়ে যায় না। সেটা ফিরে আসে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে ‘আমি’ বা ‘আমিত্ব’ জড়িত। ‘আমি’-র মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা জগতকে ব্যাক্তিগত ভাবে ভোগদখলের বাসনা থেকে যায়। ‘আমি’ আবার নিজেকে সম্পত্তির দখলদার বা মালিক হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার ফাঁক পেয়ে যায়। তাহলে বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রশ্ন এই ‘আমি’-র সঙ্গে মোকাবিলার প্রশ্ন। বিদ্যমান ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির মধ্যে ব্যক্তির রূপান্তর প্রধান বিষয় হিশাবে গণ্য করবার একটা শিক্ষা এখানে আমরা পেতে পারি।

লালনকে সহজে বিপ্লবী রাজনৈতিক চর্চার দিক থেকে বোঝার জন্য ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র দিক থেকে ওপরে কথা পেড়েছি। আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্ন মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্ন। একই সঙ্গে নিজের সঙ্গে নিজের এবং অপরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্নও বটে। এই সম্পর্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? এই দিক থেকে যদি ভাবি তাহলে দেখি লালন যখন ‘জ্যান্তেমরা’’-র কথা বলেন তখন তার একটা গভীর রাজনৈতিক মানে দাঁড়ায়। লালন সাধকদের জ্যান্তে মরবার বা মৃত্যুর আগেই মরে যাবার চর্চা করতে বলেন। এর নগদ লাভ হচ্ছে তখন মানুষের আর মরণের ভয় থাকবে না। মরণের ভয় আছে বলেই মানুষের পরকালের ভয় আছে। পরকালের ভয় থাকার অর্থ হচ্ছে ধর্মতত্ত্ববিদ বা মোল্লাপুরোহিতের বিধান ও হুকুম মেনে নেওয়া। কিন্তু জ্যান্তেমরার অর্থের সন্ধানে আমরা আরও গভীরে যেতে পাই।

ঠিক যে জ্যান্তেমরার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে জীবিত থেকেও মৃত হবার সাধনা করা। কিন্তু জীবিত থেকেও মরে যাওয়া আবার কিভাবে সম্ভব? সহজ কথায় এর অর্থ হচ্ছে  জীবের যে জীবমূলক বাসনা তাকে দমন করা। এতে মনে হতে পারে লালন জীবের জীবনকে অস্বীকার করছেন। আসলে তা নয়। আগেই বলেছি লালন ‘বর্তমান’ চর্চা করেন। অতএব জীবের জীবন ছাড়া মানুষের যে কোন জীবন হতে পারে না এই কান্ডজ্ঞান তো তাঁর অবশ্যই ছিল। শুধু তাই নয়। জীবের জীবনই সাধনার ক্ষেত্র এটাই তার মৌলিক প্রস্তাব। কারণ যাকে ‘পরম’ বা পরমার্থিক সত্য’ বলি তার আস্বাদন একমাত্র জীবের জীবনেই সম্ভব। তাহলে ‘জ্যান্তেমরা’ কথাটা জীবের জীবনকে অস্বীকার করা নয়, বরং জীবজীবনের সত্যকে নিঃশর্তে মেনে নেওয়া। জীবের জীবনে পরমের আস্বাদনের জন্যই পরমকে ‘বর্তমান’ করে তোলার জন্যই জ্যান্তে মরবার চর্চা করতে হবে।

কিন্তু জীবকে তাহলে মরবার সাধনা করতে হবে কেন? অর্থাৎ জীবমূলক কামনাবাসনা ত্যাগ চর্চার কি দরকার? দরকার কারণ মানুষ ‘জীব’ একথা সত্য, কিন্তু মানুষ শুধু জীব নয়। এ এমন এক জীব যার মধ্যে পরমার্থিক সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। মানুষ মাত্রেই পরম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির। সেই সম্ভাবনাকে বর্তমান করে তোলা সম্ভব যদি জীবমূলক কামনাবাসনার জায়গায় মানুষ পরমের আকাঙ্ক্ষা — পরমার্থিক বাসনার চর্চা করতে শেখে। বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর কামনা করা বাংলার ভাবুকতার দিক থেকে পরমার্থিক বাসনা।

অন্যদিক থেকে জীবের বাসনা মূলত ভোগের বাসনা। তাহলে জ্যান্তে মরার অর্থ মানুষের জীবনকে ভোগীর জীবনে পর্যবসিত হতে না দেওয়া। ভোগের জীবন ত্যাগ করার অর্থ হচ্ছে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককেও নতুন ভাবে বিন্যস্ত করা। জগত শুধু ভোগের বিষয় নয় এই শিক্ষা দেওয়া। জগত মানুষের কাছ থেকে আলাদা থেকে মানুষের বাইরে মানুষের ভোগের জন্য হাজির এ ভাবনা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোড়ায় যেমন সক্রিয়, তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও এই জীবমূলক বাসনার মধ্যে। যদি এতটুকু আমরা বুঝি তাহলে জ্যান্তেমরা হবার জন্য খিলকা নিয়ে ফকিরিবেশ ধারণকে আমরা শুধু লালনপন্থীদের একটা আচার আকারে নয়, মানুষের পরমার্থিক সত্যকে বর্তমান করে তোলার আবশ্যিক চর্চা হিশাবে বুঝতে শিখব। ফকিরি রহস্যও আমাদের কাছে গুহ্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকবে না।

আরও অনেক দিক নিয়ে আলোচনা দরকার। ওপরে যে তিনটি দিক নিয়ে কথা বলেছি সেই দিকে আমাদের নজর ফেরাতে পারলে কম অর্জন হবে না। লালন শাহকে নিয়ে অনেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে আরো হবে। তাঁর সাধক জীবনের চর্চা ও অনুশীলন তিনি যেভাবে করেছেন তাকে যথাসম্ভব জানা দরকার। তাঁর সাধনার আচার, অনুশীলন বিধিবিধান কেমন ছিল? তিনি সাধুসঙ্গ করতেন কিভাবে? তাঁর ‘কালাম’ বা গানের যথাসম্ভব সঠিক পাঠ নির্ণয়ের উপায় কি? ইত্যাদি দিকগুলো জানা, বোঝা ও আলোচনার দরকার আছে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই কাজগুলো তখনই এই কালে প্রাসঙ্গিক হবে যখন আমরা বাংলার ভাবান্দোলনের ঐতিহাসিক অভিমুখ ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট করে তুলতে পারব। লালনের রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য যতো বেশী নিজেদের কাছে আমরা পরিষ্কার কর তুলব ততোই ফকির লালন শাহ আমাদের জন্য ‘বর্তমান’ হয়ে উঠবেন।

সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১

বাস্তবতার নাটক এবং নাটকের বাস্তবতা - ফ্লোরা সরকার

অ্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’র সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতে সুদীর্ঘ দু’হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়। ইংরেজের হাত ধরে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলায় গ্রিক সাহিত্যের সর্বপ্রথম রসজ্ঞ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ছাত্রাবস্থায় গ্রিক শিখেছিলেন এবং পরবর্তীতে ১৮৭১ সালে গ্রিক থেকে ইলিয়াদের কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়। তার গ্রিকচর্চার একটিই ফল- ‘মেঘনাদবধকাব্য’। এর কাহিনী রামায়ণের, গঠন হোমারের। মাইকেলের পরে হয়তো স্বল্পসংখ্যক বাঙালি গ্রিকভাষা শিখেছিলেন, কিন্তু তাদের শিক্ষার কোনো ফল আমরা পাইনি। মাইকেল অ্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’র চতুর্বিংশ অধ্যায়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবে তার সমসাময়িককালে ক’জনের সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল জানা নেই। সেই অধ্যায়ের এক জায়গায় অ্যারিস্টটল নাটকে অবিশ্বাস্য সম্ভাব্যতার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অসম্ভাব্যতার প্রতিই শুধু জোর দেননি, তিনি সেইসব নাটককেই কেবল গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, অব্যাখ্যেয় খুঁটিনাটি নিয়ে একটি কাহিনী গড়ে তোলা ঠিক নয়। যতটা সম্ভব অব্যাখ্যেয় বা অসম্ভাব্য ব্যাপার কাহিনীতে না থাকাই ভালো। তারপরের অধ্যায়ে, কাব্যের সমালোচনায় অ্যারিস্টটল আমাদের জানান- ‘চিত্রকর বা অন্যান্য শিল্পীর মতো কবিও জীবনের অনুকারক। কাজেই তাকে নিম্নের এই তিনটির যে কোনো একটি অনুকরণ করতে হবে, যেমন- (১) জীবন যেমন ছিল অথবা (২) জীবন যেমন আছে অথবা (৩) জীবন যেমন হওয়া উচিত।’ যে কারণে প্রাচীন গ্রিক নাট্যকারদের মধ্যে সোফোক্লেসকে আমরা দেখি, মানুষের জীবন যেমন হওয়া উচিত, তিনি সেভাবে মানুষের ছবি এঁকেছেন। নাট্যকার এউরিপিদেসকে আমরা দেখি মানুষ যেমন তেমন করেই তিনি মানুষের ছবি এঁকেছেন তার নাটকে। এই তিনটির যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্য যদি কোনো নাটকে না দেখা যায় অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কাহিনীটি এই রকমই’।
সেই সময়ের কবি ও দার্শনিক জেনোফোনেস ক্রুদ্ধ হয়ে এসব নাটকের কাহিনীকে সত্য থেকে দূরে থাকার উল্লেখসহ কাহিনীগুলোকে জনসম্মুখে আনার অযোগ্য বলে গণ্য করেন। বরং নাটকগুলোকে ‘প্রচলিত’ ধারার বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের বর্তমান টিভি চ্যানেলের নাটকগুলো জেনোফেনাস কথিত সেই প্রচলিত ধারার ধারাবাহিকতা মাত্র। এসব নাটক বাস্তবতা দূরে থাক নিজেরাই একটা বিকৃত বাস্তব নির্মাণ করে চলেছে, যার সঙ্গে জনগণের জীবনের কোনো সংযোগ নেই। এসব সংযোগহীন নাটক নিয়ে আলোচনার আগে মঞ্চ এবং টিভি নাটকের পার্থক্যটুকু আমাদের একটু ভেবে নেওয়া দরকার।
নাটককে বলা হয় দৃশ্যকাব্য। অর্থাৎ দৃষ্টির সম্মুখে প্রদর্শিত শিল্পমাধ্যম। নাটক মঞ্চ দিয়ে শুরু হলেও, পরবর্তীতে তার বিস্তার বিভিন্ন মাধ্যমে এগিয়ে যায়। টিভি নাটক যার মধ্যে অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু টিভি নাটক এবং মঞ্চ নাটকের ব্যবধান অনেক। কেননা, মঞ্চ একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কয়েকটি সেটের মধ্যে প্রদর্শিত হয়। আর টিভি নাটকের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই। গল্পের প্রয়োজনে তা স্থান-কাল পরিবর্তিত হয়। মঞ্চনাটক সংলাপনির্ভর, টিভিনাটক স্বল্পসংলাপনির্ভর। টিভিনাটকে ফ্লাশব্যাক-ফ্ল্যাশইন যতটা স্বাচ্ছন্দ্য, মঞ্চে ততটা নয়। মঞ্চের সংলাপ অনেকটা যাত্রার ঢং-এ উচ্চারিত হলেও, টিভিনাটকের সংলাপে উচ্চস্বরের প্রয়োজন পড়ে না। মঞ্চে শিল্পীর অভিব্যক্তি যতটা তীব্রতার প্রয়োজন পড়ে, টিভিনাটকে ততটা প্রয়োজন পড়ে না। কারণ মঞ্চে দর্শক এবং শিল্পীর দূরত্ব যতটা তার চাইতে টিভিনাটকের ক্যামেরা ততটাই কাছাকাছি। মঞ্চনাটকে মঞ্চে একসঙ্গে অনেক শিল্পীর সমাগম ঘটে, কদাচিৎ একক শিল্পীকে মঞ্চে দেখা যায়, টিভিনাটকে কমসংখ্যক শিল্পীর সমাগমই অধিক। এরকম আরো পার্থক্য দেখানো যেতে পারে।
কিন্তু টিভিনাটকের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা হয় তা হলো টিভিনাটক কিছুটা মঞ্চ, কিছুটা সিনেমার মাঝামাঝি। মঞ্চ এবং সিনেমার মাঝে পড়ে টিভিনাটকের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য আমরা আজ পর্যন্ত খুঁজে দেখিনি বা চিন্তাভাবনা করিনি। তবে মঞ্চ বা টিভিনাটকের মাঝে পার্থক্য যা-ই থাক, গল্প বা কাহিনী বর্ণনার কিছু মূল ব্যাকরণ থাকে, যেসব ব্যাকরণ স্থান-কাল নিরপেক্ষ। ব্যাকরণের কোনো পরিবর্তন যেমন হয় না তেমনি মঞ্চনাটক, টিভিনাটক বা সিনেমার ব্যাকরণ কখনো পরিবর্তিত হয় না। অর্থাৎ পথ ভিন্ন হলেও গন্তব্য একই জায়গায় থাকে। সেটা অ্যারিস্টটল কথিত, জীবন যেমন ছিল বা জীবন যেমন বা যেমন হওয়া উচিত, তার যে কোনো একটা হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের টিভিনাটকে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য দূরে থাক, সেসব নাটকে আমরা কী আদৌ কোনো জীবন দেখতে পাই?
টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়। এসব নাটক নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে বিভিন্নভাবে উষ্মা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। অনেকে আজকাল টিভি দেখা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। খবরটুকু ছাড়া আর কোনো বিনোদন দর্শকরা টিভি চ্যানেলগুলোতে খুঁজে পান কিনা সন্দেহ। কিন্তু বিশেষ নাটকগুলোও যখন যেনতেনভাবে টিভিতে প্রচারিত হতে দেখা যায় তখন বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছর প্রচুর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঈদের লম্বা ছুটিতে লম্বা দিনের, কোনোটা ছয়দিন, কোনোটা সাতদিন, কোনোটা আবার আটদিনের আয়োজনে প্রচুর বিশেষ নাটক প্রদর্শিত হয়। হাতেগোনা কয়েকটা নাটক ছাড়া সেই সময়টাতে টিভির সামনে বসে থাকাই একটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এখন এবারের ঈদের সেসব তথাকথিত বিশেষ নাটকের কয়েকটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
প্রেম-রোগ থেকে টিভিনাটকের কোনো নিস্তার নেই। নিস্তার নেই সিরিয়াল রচনা থেকেও। প্রেমের নাটকের ভাইরাসের মতো আমাদের সিরিয়াল নাটকগুলোও একই রকম ভাইরাসে আক্রান্ত। সারাবছর সিরিয়ালের প্রদর্শনের পাশাপাশি ঈদের বিশেষ নাটকগুলোতেও এই সিরিয়াল নামক ভাইরাস তার বিস্তার ঘটিয়েছে। ‘প্রেমের নাম বেদনা’ নামের নাটকটি গত ঈদে দুই পর্বে প্রচারিত হয়। প্রথম পর্বে দেখা যায়, অভিনয় করতে এসে নায়িকা একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়। সমস্যাটি কী? না কোনো আর্থিক বা সামাজিক সমস্যা নয়, সমস্যা একটাই আর তা হলো পরিচালক তার প্রেমে পড়েন এবং নায়িকা সেই প্রেমে সাড়া দিতে পারেন না। ফলে তার অভিনয় জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া হয় না। অর্থাৎ দর্শককে এটাই বোঝানো হয় যে- নাটকে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে পরিচালকদের প্রেমে পড়তে হবে। নাটকের আরেকজন নায়িকাও অভিনয় করতে আসেন এবং পরিচালক তারও প্রেমে পড়েন, নায়িকা সাড়া দেন এবং তাদের যথারীতি বিয়ে হয়ে যায়। অর্থাৎ একই মানুষ একই সময়ে দুজনের প্রেমে পড়তে পারেন।
এবারের ঈদে সেই নাটকের সেই সিরিয়ালে দেখা যাবে, প্রথম নায়িকা এবার পরিচালকের প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু অপর নায়িকা তার স্বামীকে (সেই পরিচালক) ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বিকৃত বাস্তবতার উপস্থাপন দিয়ে দর্শককে আদৌ কোনো আনন্দ প্রদান করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
এবারের ঈদের আরেকটি নাটক ‘হাতে মাত্র পাঁচদিন’ নাটকে দেখা যাবে ছবি তোলার নেশায় নায়ক ঢাকা থেকে কক্সবাজার ছুটে যায়। সেখানে যথারীতি নায়িকার সঙ্গে পরিচয় হয়। কিন্তু নায়িকার জীবনে একটা অতীত আছে, নায়ক-নায়িকার সেই অতীত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার কাছে পাঁচদিন সময় চায়। মজার বিষয় হলো, বাস্তবে কেউ দ্রুত প্রেমে না পড়লেও আমাদের নাটকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নায়ক-নায়িকারা প্রেমে পড়ে যান। কারণ ‘প্রেম’ নামক বিষয়টিকে যেভাবেই হোক নাটকে আনা চাই। ‘ভালোবাসার রং’ নাটকে দেখা যাবে, নায়ক আমেরিকা থেকে ফিরছে। তাকে রিসিভ করতে যাওয়ার সময় নায়িকা জানতে পারে নায়ক বিমান দুর্ঘনায় মারা গেছে। নায়িকা সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একসময় সে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলে নায়িকা। তাকে সুস্থ করার জন্য আরেকজন নায়ক যিনি আবার পেশায় ডাক্তার তিনি ছুটে আসেন। নায়িকা সুস্থ হতে থাকে এবং যথারীতি সেই ডাক্তারের প্রেমে পড়ে। তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিয়ের আসরে হিন্দি ছবির ঢং-এ প্রথম নায়ক এসে উপস্থিত হয়। এধরনের উদ্ভট গল্প সাজিয়ে পরিচালকই বা দর্শকদের কী বোঝাতে চান আর দর্শকই বা কী বুঝে কতটুকু বিনোদন পান তার সঠিক পরিমাপ আমাদের জানা নেই।
ত্রিভুজ প্রেমে ইদানীং সম্ভবত সবার ক্লান্তি এসে গেছে। তবু এবারের ঈদে ‘শুকতারা’ নাটকে তিন তারা (নোবেল, তারিন, মিলন) বেষ্টিত ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী আমরা দেখতে পাব। আরেকটি ঈদের নাটকে নায়ককে দেখা যাবে ধনী নায়িকার বাড়ির প্রহরীর চরিত্রে। গল্পের বাকিটা জানা থাকলেও আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, সেই প্রহরী নায়কের সঙ্গে ধনী নায়িকার অবশ্যই প্রেম সম্পন্ন হবে। সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই, ঈদের প্রায় প্রতিটি নাটকের কাহিনী কম-বেশি একই ছাঁচে গড়ে তোলা হয় প্রতি বছর। যেসব নাটকের বাস্তবতা জীবনের বাস্তবতা থেকে থাকে শতহস্ত দূরে। সাধারণ মানুষের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে আর তা হলো ইন্দ্রিয় দ্বারা সে যা দেখে বা বোঝে তাকেই সে চরম বলে ভেবে বসে। আর এই সুযোগটাই আমাদের নির্মাতারা গ্রহণ করেন। ইচ্ছেমত মনগড়া বিকৃত সব কাহিনী সাজিয়ে উপস্থাপন করেন টিভি দর্শকদের সামনে। মানুষ তার জীবনে যা করে বা যা বলে তার চেয়ে বেশি সে ভাবে। জীবন যেমন বা যেমন হওয়া উচিত যেভাবেই আমরা জীবনকে নাটকে উপস্থাপন করি না কেন, শুধু সংলাপের পর সংলাপ সাজালেই তার উপস্থাপন সঠিক হয় না, জীবনের না-বলার একটা বৃহৎ অংশ থাকে, যার উপস্থাপন খুব সহজকর্ম নয়। আর তাই ‘ভাবি কেমন আছেন’ বা ‘ইস্! মাইয়াডা তো খুব সুন্দর’ জাতীয় কথামালার কথা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় আমাদের তথাকথিত টিভিনাটকগুলো।
যা পাঠযোগ্য তা দর্শনযোগ্যও বটে। যে জন্য আজও আমরা ইবসেন, ব্রেখট, শেক্সপিয়ার পাঠ করি। আমাদের টিভিনাটকের পান্ডুলিপি (অনেক নির্মাতার আবার সেই বস্ত্তটিও হাতের কাছে থাকে না। তারা এতটাই অাঁতেল যে পান্ডুলিপির প্রয়োজনই পড়ে না) পাঠযোগ্য হয় না বলেই তা দর্শনযোগ্য হতে পারে না। গ্ল্যামারাস নায়ক-নায়িকা, গ্ল্যামারাস পোশাক, গ্ল্যামারাস আসবাব, বাড়িঘর, আউটডোর সাজিয়ে দর্শকের চোখের দৃষ্টিকে শান্ত করা গেলেও মনের দৃষ্টিটা অশান্তই থেকে যায়। কারণ অন্তঃসারশূন্য কাহিনী দিয়ে আর যাই নির্মাণ করা যাক তা দিয়ে কখনোই ভালো নাটক নির্মাণ করা যায় না। অনেক নির্মাতা এবং দর্শককে আজকাল বলতে শোনা যায়- নাটকে এত সিরিয়াস কিছু দেখাবার দরকারটাই বা কী? বিনোদন থাকবে বিনোদনের জায়গায়। আমরাও এর সঙ্গে একমত। কিন্তু বিনোদনের নামে যখন প্রহসন করা হয় তখন বিষয়টা ভাবিয়ে তোলে বৈকি। ঈদের মোড়কে পোশাকের দোকানিরা যেমন সারা বছরের বাণিজ্য করে নেন এই সময়ে,  নাটকের নির্মাতারাও বছরের এই সময়টায় একই উদ্দেশ্যে বসে থাকেন। এতে হয় তো বাণিজ্য হতে পারে খুব ভালো, কিন্তু নাটক নির্মিত হয় না। নাটক শুধু পান্ডুলিপিনির্ভর কোনো শিল্পমাধ্যম নয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে সংলাপ, অভিনয়, শব্দগ্রহণ, আবহসঙ্গীত, সম্পাদনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। স্থানাভাবে আজ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো না। পরবর্তী কোনো একসময়ে তা করা যাবে।
নাটক নামক শিল্পকর্মটি যে খুব সহজ কাজ নয় তা বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, নাট্যকার দিদেরো তার একটি কথা দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন- ‘যিনি নাটক লিখবেন তাকে অবশ্যই প্রথমত একজন দার্শনিক হতে হবে, যিনি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে এবং অপরকে দেখতে পাবেন, তাকে অবশ্যই মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে খুব ভালোমতো অবগত থাকতে হবে, সে তার সামাজিক পরিবেশের ছাত্র এবং সেই সমাজের কার্যাদি, গুরুত্ব, সমাজের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো অবগাহন করতে হবে। কোনো শিশুচিত্ত নাট্যকারের পক্ষে সমস্যামূলক নাটক লেখা সম্ভব নয়, কারণ সমস্যামূলক নাটকে প্রয়োজন হয় নান্দনিকতা, গভীর জ্ঞান, আভিজাত্যবোধ এবং বুদ্ধিমত্তার শক্তি। অন্তর্লোক এবং বহির্লোকের (মানুষ+চরিত্র+সমাজ+ব্যবস্থা) পরিপাটি জ্ঞান যার নেই তার পক্ষে মহৎ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।’ এসবই হচ্ছে নাটকের সেই ব্যাকরণ, যা কখনো পুরনো হয় না, বাণী চিরন্তনের মতো বেঁচে থাকে। আশা করব আমাদের বর্তমান নির্মাতারা কিছুটা হলেও তাদের জ্ঞানের ভান্ডারের চর্চা করবেন এবং আমাদের পতিত নাটকগুলো থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন। তখন আমরা নাটকের বিকৃত এসব বাস্তবতা নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন, জীবনের প্রতিফলন নাটকে দেখতে পাব।