সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

রবীন্দ্র-স্মৃতি - কবি জসীম উদ্দীন

যার ভেতর অনুপ্রেরণা থাকে সেই পারে অপরের প্রেরণা যোগাতে। বড় মনের মানুষেরাই হতে পারে বড় মাপের কবি। তারা নিজেরাও যেমন বড় হয়, অপরকেও বড় হতে সহায়তা করে। আর তাই কবি জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথায় আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য এবং মধুর স্মৃতিচারণ করতে দেখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে সেই মধুর স্মৃতিচারণ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ সাপ্তাহিক বুধবারের পক্ষ থেকে পেশ করা হলো।
অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বন্ধু। দুইজনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়া একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে রওয়ানা হইলাম। তখন বর্ষাকাল। কদমফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ তোড়া নানা রকমের ফুলদানিতে সাজানো। আধ-ফোটা মোটা মোটা কেয়াফুলের গুচ্ছগুলি কবির সামনে দুইটি ফুলদানি হইতে গন্ধ ছড়াইতেছিল। বেলিফুলের দু’গাছি মালা কবির পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। মনে হইতেছিল, বাংলাদেশের বর্ষা ঋতুর খানিকটা যেন ধরিয়া আনিয়া এই গৃহের মধ্যে জীবন্ত করিয়া রাখা হইয়াছে। চারিধার হইতে সবকিছুই মূক ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলিতেছিল। কবি যদি আমার সঙ্গে কোনো কথাই না বলিতেন, তবু আমি অনুতাপ করিতাম না। সালাম জানাইয়া কম্পিত হস্তে আমি নকশিকাঁথার মাঠ আর রাখালী পুস্তক দুইখানি কবিকে উপহার দিলাম। কবি বই দুইখানি একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলাদেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখিয়াছ। তোমার বই আমি পড়িব’।

প্রথম পরিচয়ের উত্তেজনায় সেদিন কবির সঙ্গে আর কি কি আলাপ হইয়াছিল, আজ ভালো করিয়া মনে নাই। ইহার দুই-তিনদিন দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মাধ্যম ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘তুমি কবিকে বই দিয়ে এসেছিলে। আজ দুপুরে আমাদের  সামনে কবি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কবিতার প্রশংসা করলেন। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে প্রকাশ করেছেন, তিনি তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবেন।’

পরদিন সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। কবি আমার বই দুইখানির প্রশংসা করিলেন। বলিলেন, ‘আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েই তোমার বই দুইখানার উপর বিস্তৃত সমালোচনা লিখে পাঠাব। তুমি শান্তিনিকেতনে এসে থাকো। ওখানে আমি তোমার একটা বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, ‘এখানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তো পড়া হবে না।’

কবি বলিলেন, ‘ওখান থেকে ইচ্ছে করলে তুমি প্রাইভেট এমএ পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি সে বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি উত্তরে বলিলাম, ‘ভালো করে ভেবে দেখে আমি আপনাকে পরে জানাব।’

কলকাতায় আমার সবচাইতে আপনজন ড. দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমাকে কলিকাতা ছাড়িয়া শান্তিনিকেতনে যাইতে নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘কবি যদি এত বৃদ্ধ না হতেন তবে আমি তোমাকে ওখানে যেতে বলতাম। কিন্তু কবি কতকাল বেঁচে থাকবেন, বলা যায় না। এখান থেকে এমএ পাস করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করো। ওখানকার আশ্রয় বহুদিন পাওয়ার সৌভাগ্য তোমার না-ও হতে পারে।’ আমার আর শান্তিনিকেতনে যাওয়া হইল না।

প্রায় দুই মাস হইয়া গেল। কবি আমার বই-এর সমালোচনা পাঠাইলেন না। মোহনলালকে দিয়া কবিকে পত্র পাঠাইলাম। কবি একটা ছোট্ট চিঠিতে মোহনলালকে লিখিয়া পাঠাইলেন, ‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ কবির এই কথাগুলি নকশিকাঁথার মাঠে ছাপা হইলে বাংলাদেশের বহু সাহিত্যিক ইহার প্রশংসা করিয়াছিলেন। যাঁহারা বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে প্রস্ত্তত হইতেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই প্রশংসার পরে তাঁহারা আর সে বিষয়ে সাহসী হইলেন না।

ইহার পর রবীন্দ্রনাথ যখনই কলিকাতা আসিয়াছেন, আমি অবসর পাইলেই গিয়া দেখা করিয়াছি। আমাকে দেখিলেই কবি তাঁর বিগতকালের পদ্মাচরের জীবন লইয়া আলোচনা করিতেন। তখন আমি বালুচর বইয়ের কবিতাগুলি লিখিতেছি। ইহার অধিকাংশ কবিতাই ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। মাসিকপত্রে ইহার অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। সমালোচকেরা বলিতে লাগিলেন, ‘তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন করো।’

একদিন কবিকে এই কথা বলিলাম। কবি বলিলেন, ‘ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার করো। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মতো। তাতে কোনো প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।’

রাজরানী নাটকখানি নতুন করিয়া লিখিয়া রবীন্দ্রনাথ ইহার তপতী নামকরণ করিলেন। এই নাটক মহাসমারোহে কবি কলিকাতায় অভিনয় করিলেন। এই অভিনয়ে কবি রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধ কি করিয়া প্রেমের অভিনয় করিবেন, তাঁহার শাদা দাড়িরই বা কি হইবে, অভিনয়ের পূর্বে এইসব ভাবিয়া কিছুই কূল- কিনারা পাইলাম না। কিন্তু অভিনয়ের সময় দেখা গেল দাড়িতে কালো রং মাখাইয়া মুখের দুই পাশে গালপাট্টা তুলিয়া দিয়া কবি এক তরুণ যুবকের বেশে মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তপতী নাটকে রাজার ব্যর্থ প্রেমের সেই মর্মান্তিক হাহাকার কবির কণ্ঠমাধুর্যে আর আন্তরিক অভিনয় নৈপুণ্যে মঞ্চের উপর জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতা দেখিয়াছি। তাহাতে এই পরিবর্তন ও এত কাটাকুটি যে দেখিয়া অবাক হইতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি কিছু করিয়া তৃপ্ত হইতে জানিত না। তিনি আজীবন এতো গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাহার প্রত্যেকখানিতে তাঁহার মনের একান্ত যত্নের ছাপ লাগিয়া রহিয়াছে। গ্রন্থগুলি লিখিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি অপরকে দিয়া নকল করান নাই। যতবার নকল করিতে হয় নিজেই করিয়াছেন এবং  প্রত্যেকবারেই সেই রচনার ভিতর তাঁহার সৃজনীশক্তির অপূর্ব কারুকার্য রাখিয়া গিয়াছেন।

তপতীর পরেও নাটক রচনার নেশা রবীন্দ্রনাথকে পাইয়া বসিয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে একদিন আমি পাড়াগাঁয়ের লোকনাট্য, আসমান সিংহের পালার উল্লেখ করিলাম। কথা প্রসঙ্গে কবি আমাকে বলিলেন, ‘তুমি লেখো না একটা গ্রাম্য নাটক।’ আমি বলিলাম, ‘নাটক আমি একটা লিখেছি। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ পড়ে বলিলেন, নাটক লেখার শক্তি তোমার নেই।’ কবি একটু জোরের সঙ্গে উত্তর করিলেন, ‘অবন নাটকের কি বোঝে? তুমি লেখো একটা নাটক তোমাদের গ্রাম দেশের কাহিনী নিয়ে। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে দেবো।’ আমি বলিলাম, ‘একটা প্লট যদি দেন তবে আর-একবার চেষ্টা করে দেখি।’ কবি বলিলেন, ‘আজ নয়, কাল সকালে এসো।’ কবির এই প্লট অবলম্বন করিয়া আমি নাটক রচনা করিয়াছিলাম। দুই- তিনবার অদলবদল না করিয়া কিছুতেই কোনো লেখা আমি প্রকাশ করি না। তাই কবি জীবিত থাকিতে তাঁহাকে এই নাটক দেখাইতে পারি নাই। পল্লীবধূ নাম দিয়া এই নাটক কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে। ঢাকা বেতারে এই নাটক অভিনীত হইয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করিয়াছে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বাঁচিয়া থাকিতেন, তাঁহাকে এই নাটক উপহার দিয়া মনে মনে কতই না আনন্দ পাইতাম।

শুক্রবার, ৬ মে, ২০১১

সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতায়

এক জীবনে একজন কবির জন্মশত ও সার্ধ শতবার্ষিকী দেখার সুযোগ আমরা যারা লাভ করেছি, তারা ভাগ্যবান। আরও বেশি সৌভাগ্যশালী তারা, যারা দু’টি উপলক্ষই প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত বয়সে, সুস্থ মননে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী পালিত হয় ১৯৬১ সালে, তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার অধিবাসী। পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ‘অমুসলিম’ কবিকে নিয়ে মাতামাতি শাসক শ্রেণীর কাছে সুখকর মনে হওয়ার কথা নয়, এবং তা মনে হয়ওনি। যদিও রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আদেশ তখনও জারি করা হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তখন ঢাকার সাহিত্যজগতের নেতৃত্বে ‘সমকাল’ নামক সাহিত্য মাসিক। কবি সিকান্দার আবু জাফরের মতো সিংহপুরুষ, সহযোগী কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে নিয়ে অকর্ষিত জমিকে শস্য শ্যামলা করার মতো ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে সাহিত্যের শস্যভাণ্ডার সৃষ্টির ব্রত নিয়ে সমকাল বের করেন এক বৈরী সময়ে।
গত শতকের ষাটের দশক আমাদের সাহিত্যজগত তার পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে উজ্জ্বল দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তার অনেকটা কৃতিত্বেরই দাবিদার সমকাল।
টিকাটুলির অভয় দাস লেনের একতলা প্রায়ান্ধকার বাড়ি থেকে প্রকাশিত মাসিক সমকাল পত্রিকার অফিসটি ছিল প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের এক মিলন ক্ষেত্র আর এর প্রধান সেনাপতি ছিলেন সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর। তিনি শুধু সম্পাদনার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেননি। তখনকার দিনে বিভিন্ন উপলক্ষের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন একজন সফল সংগঠক হিসেবে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী সমাগত। যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উপলক্ষটি উদযাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো তখনকার দিনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের। নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে আয়োজনে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হলো। অধ্যাপক আবুল ফজল, কবি সুফিয়া কামাল তখন আমাদের সাহিত্যজগতের উজ্জ্বল নাম। অধ্যাপক আবুল ফজল চট্টগ্রাম নিবাসী। কবি সুফিয়া কামাল ঢাকায়। শুধু তাই নয়, সমকাল অফিসের পাশেই একই সড়কে তাঁর বসবাস।
এই ধারার নিষেধাজ্ঞার ফলে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যারা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদযোগটি নিলেন, তারা নিষেধের অচলায়তন ভাঙার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তা করলেন। সমকাল পত্রিকার অফিসে প্রতিনিয়ত সভা করে জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের কর্মসূচি প্রণয়নের কাজের সঙ্গে সঙ্গে সমকালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। অন্যূন শত পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় দেশের সেরা লেখকদের লেখা অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা সম্পাদক উচ্চকণ্ঠেই জানিয়ে রাখলেন।
রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা কারা লিখবেন, কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হবে এই সংখ্যায় লেখার জন্য, তার তালিকা তৈরি করে নানারকম কাটছাঁটের পর চূড়ান্ত করা হলো। লেখা চেয়ে নির্বাচিত লেখকদের কাছে চিঠিও গেল। আজ ভাবতে অবাক লাগে, কী এমন সুকৃতির অধিকারী ছিলাম যে একটি চিঠি আমার নামেও পাঠানো হয়েছিল! সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের স্নেহ ও ঔদার্যের কারণেই যে লেখক তালিকায় ছন্দপতন ঘটেছিল, আজ এত বছর পরে বুঝতে কষ্ট হয় না।
লেখার সুযোগ পেয়ে মনে হয়েছিল শতাব্দীর সূর্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে পারা, তাও বিশেষ সংখ্যায়, অবশ্যই একজন লেখকের জন্য বিরল সুযোগ এবং এই সুযোগের সদ্ব্যবহার নির্ভর করে লেখকের ব্যক্তিগত যোগ্যতার ওপর। লেখার সুযোগ পাওয়াকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচনে বেশ চিন্তিত থাকতে হয়েছে কিছুদিন। রবীন্দ্রনাথের গল্প কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও লেখা হবে।
বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে পঠন তালিকায় রবীন্দ্র-সাহিত্যের শীর্ষ অবস্থানের কারণে তাঁর সাহিত্য নিয়ে শিক্ষকদের আলোচনা, সহায়ক গ্রন্থ আমাদের, ছাত্র-ছাত্রীদের রবীন্দ্র-সাহিত্য সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিল, তা তখনকার দিনে মনে হতো মুগ্ধতাবোধ দ্বারা প্রভাবিত। দু-একজন শিক্ষক রবীন্দ্র-কবিতার প্রসঙ্গে ভাবাবেগে আক্রান্তও হতেন। আজ এত বছর পর মনে পড়ে একজন ডাকসাইটে শিক্ষক রবীন্দ্র-কাব্যকে তুলনা করেছিলেন কাঁচাগোল্লার সঙ্গে। মুখে দিলেই যা মিইয়ে যায়। কী স্থূল উপমা!
আমরা চেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথকে তার সবলতায় ও দুর্বলতায় আবিষ্কার করতে। সুতরাং ছিদ্রান্বেষণের মতো সন্ধান করতে লাগলাম রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক। যেদিকে তাকাই, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সোনালি ফসল। কী গান, কী কবিতা, কী গল্প, কী প্রবন্ধ, কী উপন্যাস। এমন সফল লেখক এর আগে বাংলা সাহিত্য আর পায়নি। তিনি যদি আর কিছু না লিখে শুধু গানই লিখতেন, তাতেও অমরত্বের দাবিদার হতেন। এবং কট্টর রবীন্দ্র সমালোচকেরও মতে, কালের প্রহার এড়িয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যের যা বেঁচে থাকবে, তা হলো তার গান।
তা হলে কি রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক বলতে কিছু নেই? অবশ্যই আছে। মহাবীর একিলিসের দুর্বলতা যেমন ছিল তার পায়ের গোড়ালির নিচে, স্যামসনের কেশরাজি, রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক মনে হয়েছে তাঁর সমালোচনামূলক রচনাবলী। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রিয়জনদের লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি, তখন মনে হতো, লেখার দুর্বলতার দিক এড়িয়ে লেখককে উত্সাহ দেয়ার জন্য প্রশংসাসূচক কথাবার্তাই বেশি বলতেন।
কিছু নমুনা লেখা জোগাড় করে একটি নিবন্ধ ফেঁদেছিলাম—‘সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ’।
‘সমকাল’ রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যার সব লেখাই মানোত্তীর্ণ ছিল, এমন দাবি সম্পাদক নিজেও করেননি। ফসলের সঙ্গে আগাছাও জন্মায়। তেমনি মূল্যবান সব লেখার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেই বালখিল্য ও অপরিণত নিবন্ধটি, যার অস্তিত্ব আজ অস্বীকার করতে পারলে খুশিই হতাম!
সমকালের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশের কিছুদিন পর নিউ মার্কেটের অধুনাবিলুপ্ত বইয়ের দোকানে একটি বিশালাকার গ্রন্থের উপস্থিতি তখন যে কী পরিমাণ মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছিল, আজ তা ভাবলে অবাক হই।
ভারতের সাহিত্য একাডেমী প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর : এ সেন্টেনারি ভল্যুম (১৮৬১-১৯৬১) হার্ড কভারের গ্রন্থটি প্রথম হাতে নিয়ে যে অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়, আজ তার বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। সেই কালে ছয়শ’ টাকা দিয়ে বইটি কিনে অবিমৃষ্যকারিতার প্রমাণ যে দিয়েছিলাম, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম পরবর্তী সময়ে জীবন ধারণে কৃচ্ছ্রতাসাধনে বাধ্যবাধকতার কারণে! কিন্তু কৃচ্ছ্রতা হাসিমুখে সয়েছি অর্জিত সম্পদের ঐশ্বর্যে।
বইয়ের ভেতরে যত দেখি, মুগ্ধতা কেবলই বাড়ে। বিশাল গ্রন্থটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন দার্শনিক পণ্ডিত এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ। লেখকসূচি দেখে আরও চমকিত হই। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুলক রাজ আনন্দ, লীলা মজুমদার, ধুর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর, ড. নীহার রঞ্জন রায়, বুদ্ধদেব বসু, ভবানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। দেশি লেখকদের তুলনায় বিদেশি লেখকদের তালিকাটি আরও সমৃদ্ধ। এমন সব লেখকের নাম রয়েছে যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য প্রবাদতুল্য। রবীন্দ্র-সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের নিবিড় সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। এ তালিকায় রয়েছেন লেনার্ড এলমহার্স্ট, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার নাম রেখেছিলেন বিজয়িনী), ‘গুড আর্থ’, ‘মাদার’ উপন্যাস খ্যাত পার্ল এস বাক, সিসেপ তুসি, নোবেল বিজয়ী রিচার্ড চার্চ, তোশিহিকো কাতাইমা, আরনল্ড কাইজার লিং, জোসেফ লায়েনবাচ, অ্যান্ডারস ওস্টার লিং, চীনা পণ্ডিত পিং-সিন, আলবার্ট সোয়েত্জার, মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট, আইসল্যান্ডের নোবেল বিজয়ী ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট পিপল’ উপন্যাস খ্যাত হ্যালডর কিলিয়ন ল্যাক্সনেস, পোল্যান্ডের লেখক টাডেউত্ পোবোজনিয়াক ও স্টেলা ক্রামরিশ। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর লেখক পরিচয়ে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়।
দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে তার জন্মশতবার্ষিকীতে এর চেয়ে সমৃদ্ধ কী আর উপহার দিতে পারত জন্মভূমি ভারত? বন্ধনহীন উত্সাহে ভারতে উদযাপিত হয় কবির জন্মশতবার্ষিকী। পক্ষান্তরে বাংলাভাষী তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে কবির জন্মবার্ষিকীর উদ্যাপন ছিল সাহসে-ভরা অচলায়তন ভাঙার মতো ব্যাপার। প্রাণের উচ্ছ্বাসে যা ছিল সমৃদ্ধ।
আয়োজনে হয়তো ছিল না জৌলুস, ছিল না আড়ম্বর। কিন্তু সেসব আয়োজনের আন্তরিকতা, আজ এত বছর পরে যখন রবীন্দ্র উত্সব উদযাপিত হয় রাষ্ট্রীয়, সরকারি আনুকূল্যে, পরিমাপ করার সাধ্য কি বর্তমান সময়ে? আয়োজনের দীনতা ঢাকা পড়ে গেছে আবেগ আর আন্তরিকতায়। সমকালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যা এ দেশে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে তাই এক মাইলফলক।
\ ২ \
পঞ্চাশ বছর পরে উদযাপিত হচ্ছে কবির সার্ধ শতবার্ষিকী। বিশ্বব্যাপী আয়োজনের ঘনঘটা। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। এবার শুধু বাধা-বন্ধনহীন পরিবেশেই নয়, সম্পূর্ণ অনুকূল বাতাবরণে উত্সবের আয়োজন হচ্ছে দেশব্যাপী। এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে এর প্রস্তুতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের নতুন সংস্করণ ও তার সম্পর্কে নতুন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশেও। এবং এর সূচনা হয়েছে গত বছর আগস্ট মাসে ‘শুধু রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটি প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। বিগত বছরে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিকের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলী থেকে নির্বাচিত পঁচিশটি রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন বহুমাত্রিক লেখক শাহাবুদ্দীন নাগরী। চন্দ্রাবতী একাডেমী প্রকাশিত এই প্রবন্ধ সংকলনটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে গণ্য হবে। সুমুদ্রিত এই সংকলনটি রবীন্দ্রচর্চায় গতির সঞ্চার করে।
বিদেশে ইতিমধ্যে বেশ কিছু রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘এ টেস্ট অব টেগোর : পোয়েট্রি, অ্যান্ড প্লেইজ। সম্পাদনা : মেরিন শ্যাপল্যান্ড, প্রকাশক : গ্রিন বুক্স্।’ ‘এম্পায়ার, ন্যাশনালিজম অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড। মাইকেল কলিন্স। বুটলেজ পাবলিকেশন্স।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে চার খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী। সিলেকটেড পোয়েমস, রাইটিংস অন লিটারেচার অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ, সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ, সিলেক্টেড রাইটিংস ফর চিলড্রেন।
আর সভা-সমিতি তো নিয়মিতই আয়োজন করা হচ্ছে। এ বছরের ১২ এপ্রিল ইলিনয়ের আরবালা, শ্যাম্পেনের চ্যানিং-মারে ফাউন্ডেশনে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়াম ও প্রদর্শনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রথম অনুষ্ঠান এবং এটাই হওয়া স্বাভাবিক। কেননা এই আরবানা-শ্যাম্পেন ভ্রমণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক। সেটা ১৯১২ সালের কথা। এরও ইতিহাস আছে। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরেক ছাত্র সন্তোষ মজুমদারকে আরবানা-শ্যাম্পেনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পাঠান কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। (কলকাতা জোড়াসাঁকোর বনেদি ঠাকুরবাড়ির জাতকের কৃষিসংলগ্নতার প্রমাণ এর মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত)। ১৯০৬-১৯১০ সালে সেখানে তারা পাঠ শেষে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্নাতকোত্তর লেখাপড়া না করে রথীন্দ্রনাথ আরবানা ত্যাগ করেন। ১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ প্রথম আরবানা আসেন। দুই বার রবীন্দ্রনাথ ইলিনয়ে এসেছিলেন। শেষবার রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছিলেন ১৯৩০ সালে। সেবার নিউইয়র্কে তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কের তত্কালীন গভর্নর ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট (পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং তিন টার্মে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট), নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন উপন্যাসিক সিনক্লেয়ার ল্যুইস এবং আরো পাঁচশ’ অতিথি।
এর আগে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ আর একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ফলে স্বাভাবিক কারণেই তখন তাঁর বিষয়ে উত্সাহ অনেক বেশি। সম্মানীর বিনিময়ে তিনি বক্তৃতা দেন। প্রতি বক্তৃতায় আয় তাঁর সাতশ’ থেকে হাজার ডলার, পশ্চিমের বস্তুতান্ত্রিকতার সমালোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। সমালোচনা থেকে বাদ যায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
মিনেপলিস ট্রিবিউন পত্রিকা লিখল : ভারতবর্ষের সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ। গালমন্দ শুনতে একজন মার্কিনীকে গচ্চা দিতে হয়েছে সাতশ’ ডলার।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে মার্কিনিদের শ্রদ্ধাবোধ আজও কিছু কমেনি।
বর্তমান জটিল বিশ্বে তাদের কাছে কবিকে অনেক প্রাসঙ্গিক মনে হয়। যার প্রকাশ ঘটবে বর্ষব্যাপী আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্তমান সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীতে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর সাহিত্যকর্ম পাঠ করে দিশা পাওয়া যেতে পারে বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মহামানবের’ আগমন বার্তা শুনেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে একজন মহামানব প্রত্যাশিত হলেও মানবজাতি তার আগমন বার্তা শুনছে না। বর্তমান সময়ের এটাই বড় সঙ্কট। 

                                                                                                                  - ফ খ রু জ্জা মা ন চৌ ধু রী

বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১১

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ডিটেলের ব্যবহার

পৃথিবীর যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ তাদের স্ব স্ব কাজকে নিছক কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন না। ধ্যান হিসেবে গ্রহণ করেন। সৃষ্টিশীল লেখক বা নির্মাতারা ধ্যানীর ন্যায় তাদের কাজগুলো সৃষ্টি করেন বলেই, পাঠক বা দর্শক সেই সৃষ্টিশীল কাজ ধ্যানীর ন্যায় পড়েন বা পর্যবেক্ষণ করেন। কথাটা শিল্পসহ পৃথিবীর যে কোনো কাজের জন্য প্রযোজ্য। কাজ আর ধ্যান এক কথা না। কাজ যে কেউ করতে পারে, কিন্তু ধ্যান সবাই করতে পারে না। কাজের সঙ্গে যখন ধ্যান যুক্ত হয় তখন তা শুধু সৃষ্টি হয় না, মহান সৃষ্টি হয়। এই কারণে দর্শক যখন সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখতে বসেন সেই দর্শক ধ্যানী না হয়ে পারেন না। সত্যজিৎ জানেন কী করে নিজেকে এবং অপরকে ধ্যানী করতে হয়। লেখক বা নির্মাতা তখনই ধ্যানী হতে পারেন যখন সেই কাজটার ভেতর নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করে ফেলতে পারেন। এই নিমজ্জন তখনই হয় যখন কাজটার খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিসের প্রতি তার থাকে সতর্ক, তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গীকেই সিনেমার পারিভাষিক ভাষায় আমরা বলে থাকি ডিটেল। যা সিনেমার পরিবেশকে ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে। নিখুঁত করে। বাস্তবানুগ করে। ছবিতে যে কোনো সুর বা রস নিয়ে আসতে পারে, পরিবেশ, চরিত্র, মুহূর্তকে বিশ্বাস্য করে তুলতে পারে। নিও-রিয়ালিস্ট চিত্রনির্মাতা সত্যজিতের প্রতিটা ছবিতে আমরা এই ডিটেলের অন্তর্দৃষ্টি পাই বলেই তার ছবিগুলো এতো হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। বারবার তার ছবি দেখলেও মনে হয় না ছবিটা দেখেছি আগে। ২৩ এপ্রিল ছিল তার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং ২ মে ৯০তম জন্মবার্ষিকী। তার এই মৃত্যু এবং জন্মবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ।
ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঞ্চনির্দেশক ও চলচ্চিত্র অভিনেতা উৎপল দত্ত সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ প্রতিভা দু’ধরনের দেখা যায়। কেউ একটি বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী হন, কেউ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হন। সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।’ সত্যজিতের শুধু ছবি নিয়ে যখন আলোচনা করা হয় তখন তার ছবির এত বহুমুখীনতা থাকে যে, সবদিক নিয়ে আলোচনা করতে বসলে বিরাট গ্রন্থ হয়ে যায়। তার নির্মিত ৫টি তথ্যচিত্র (রবীন্দ্রনাথ টেগোর, ইনার আই, বালা, সুকুমার রায়, সিকিম) ছাড়া শুধু কাহিনী চিত্রের সংখ্যা ২৬/২৭টির কম নয়। এতগুলো ছবিরও ডিটেল নিয়ে আলোচনা করা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আমরা তার কয়েকটা ছবি নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

অ্যাটমসফেয়ারিক ডিটেলের জন্য সত্যজিৎ কাহিনীর প্রেক্ষিতে ‘স্থান’কে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতেন। তাই ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম বোঝাতে কাশফুলে ঢাকা প্রান্তর, দিগন্তরেখার একটি রেললাইন আর বাঁশগাছে ঘেরা একটি পুকুর দেখতে পাই। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় দেখি দার্জিলিং বোঝাতে পাহাড়ি পথের বাঁক, ভাঙা রেলিং আর একটি ল্যান্ডমার্ক। ‘অভিযান’ ছবিতে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার একটি গঞ্জ দেখাতে গিয়ে খন্ড খন্ড পাথরের তৈরি টিলাক্ষেত্র, দু’পাশে রুক্ষ প্রান্তরের মাঝ দিয়ে কালো পিচের রাস্তা চলে যেতে দেখা যায়, বাস-ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের একটা অংশ, চায়ের দোকান, চটে ঘেরা অস্থায়ী সিনেমা হল, সস্তা সার্কাসের দলের তাঁবু, দেখি মদের দোকান, আফিমের চোরা কারবার, বিহারী বেশ্যা, আধা-শহুরে পুলিশ ফাঁড়ি, এসডিওর বাংলো, প্রাইভেট বাস, কয়লার ট্রেন এবং এমন আরো অনেককিছু। ‘মহানগর’ ছবিতে নাগরিক কলকাতা এবং নগর জীবনকে ফুটিয়ে তোলার জন্য দেখি যানবাহন, মধ্যবিত্ত ঘরের বউয়ের চাকরি করতে যাওয়া, চিকিৎসকের চেম্বারে সরেস ম্যাগাজিন, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, স্থাপত্য, পোশাক এবং আরো অনেক কিছু। সেই সঙ্গে নাগরিক জীবনের অন্যতম প্রতীক এডিথ। এডিথের উপস্থিতি ‘মহানগর’ ছবির প্রেক্ষিতকে দেয় মহানাগরিক চেহারা। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে মাত্র সাত মিনিটের চারটি দলের ভূতের নৃত্যের মাধ্যমে সত্যজিৎ বাংলার অতীতকে তুলে আনেন। সেখানে রাজা, কৃষক-সাঁওতাল, বিদেশী বণিক থেকে শুরু করে দেশী পেশাদার মানুষ কেউ বাদ পড়েনি।‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে রাজার মূর্খতা, নিচুতা, অত্যাচার-নির্যাতন দেখাবার জন্যে সত্যজিৎ রাজার মুখের ভাষাই বদলে ফেলেন। রাজাকে আমরা প্রমিত বাংলায় কথা বলতে শুনি না।

আবার বিভিন্ন ছবির চরিত্রের অভিব্যক্তি বা চরিত্রের বিবর্তন প্রকাশের জন্য দেখি বিহেভিয়রিস্টিক ডিটেল ব্যবহার করতে। ভ্রমণ মানুষকে জ্ঞানী হতে শেখায়, তাই সত্যজিতের অপু থেকে শুরু করে আগন্তুকের মনোমোহন ঘুরে বেড়ায়। ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অপুর সংসার’-এ তাই ট্রেন হয়ে ওঠে অপুর জীবনের গতি এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি দুর্দান্ত প্রতীক। যে অভিজ্ঞতার কারণে ‘অপুর সংসার’-এর অপু তার স্ত্রী বিয়োগের পর যখন বিবাগী হয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়, এর মাঝেও নাম না জানা গাছের পাতার দিকে তার দৃষ্টি পড়ে। পাতাটিকে সত্যজিৎ খুব কাছ থেকে দেখান। ঠিক সেই মুহূর্তে অপু কোনো এক অজানা জ্ঞান হয়ত সঞ্চয় করেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে সে পরবর্তীতে তার ছেলে কাজলের কাছে ফিরে যায়। ভ্রমণে জ্ঞানী হওয়ার কারণে ‘আগন্তুক’-এর মামাকে (উৎপল দত্ত) তার ভাগ্নী (মমতা শঙ্কর) যখন তাকে জিজ্ঞেস করে উনি কি খেতে পছন্দ করেন, উত্তরে মামা বলেন, ‘‘আমি সর্বভূক এবং স্বল্পাহারী।’’ কিন্তু একই ভ্রমণ ‘নায়ক’ ছবির নায়ককে কোনো অভিজ্ঞতা এনে দেয় না।  ‘নায়ক’ ছবিটির প্রায় পুরোটাই ট্রেনের ভেতরে কাহিনী গড়ে ওঠে। সিনেমার নায়করা সাধারণত আত্মকেন্দ্রিক, আত্মগর্বী, আত্মম্ভরি এবং অন্যের প্রতি থাকে উদাসীন। ছবির নায়ক তাই ট্রেনের একই কম্পার্টমেন্টের অসুস্থ মেয়েটির প্রতি থাকে নিষ্পৃহ, সাংবাদিক অদিতি তার সামনে কেবল আয়না হয়ে থাকে। অনেক ভ্রমণ আর অনেক মেলামেশা তাকে জ্ঞানী করতে পারে না। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য়, দার্জিলিংয়ের এতো চমৎকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য থাকতেও চরিত্রগুলোর বিচ্ছিন্নতা এবং ধোঁয়াটে সম্পর্ক বোঝাবার জন্যে সত্যজিৎ বেছে নেন কুয়াশা ঘেরা হিমালয় পাহাড়। সারা ছবির কোথাও আমরা হিমালয় পাহাড়কে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই না। একমাত্র শেষ দৃশ্যে হিমালয় নিজ চেহারায় ফুটে ওঠে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর) একেবারে আলাদা জগতের মানুষ বলে বনের ভেতর সবার থেকে সে আলাদা হয়ে বসে। অপর্ণা যে ধরনের বই পড়ে, গান শোনে- তা অন্যদের থেকে আলাদা। অপর্ণার ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায় এটা শুধু তারই পড়ার ঘর। জমির এক কোণায় পড়ে থাকা এক টুকরো ঘর- এটাই যেন অপর্ণার চরিত্রের যথার্থ ব্যঞ্জনা। আর তার ঠিক বিপরীতে অপর্ণার বৌদি জয়া ত্রিপাঠিকে আমরা দেখি- সে বই পড়তে ভালোবাসে না। বাঙালির আত্মপ্রবঞ্চনার চরিত্রটি এই ছবিতে আমরা চমৎকারভাবে ফুটে উঠতে দেখি। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটির কাছেও নিজেকে অকারণে বড় করে দেখানোর প্রবণতা বাঙালি যুবকদের প্রবল। কিন্তু নায়ক অসীমের এই মুখোশ বারবারই ধরা পড়ে যায় অপর্ণার কাছে। বিশেষত মেমরারি গেমের মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ অত্যন্ত মুনসিয়ানার মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলেন। ঠিক একই রকম আরেকটা চরিত্র আমরা দেখি ‘জন অরণ্য’ ছবির মি. গোয়েঙ্কার মধ্যে। যিনি একটি কোম্পানির বড় এক্সিকিউটিভ, স্ত্রীকে ভয় করেন, কিন্তু হোটেলে নারী নিয়ে রাত কাটান, প্রার্থনা সভায় বসেন, আবার কৌশলে ঘুষ খান। সুটেড-বুটেড এই লোকটি যখন সোমনাথকে নিয়ে গাড়ি করে যান, তার গাড়ির হোল্ডারের ঢাকনাটি বার বার পড়ে যায়, সোমনাথ যেটা বার বার হাত দিয়ে লাগিয়ে দেয়। হোল্ডারের নড়বড়া ঢাকনাটি মি.গোয়েঙ্কার নড়বড়ে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য যেন যথেষ্ট। সোমনাথ যখন বুঝতে শুরু করে যে সে ধীরে ধীরে অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার সরল মনের কোনো সায় নেই, একটি মাত্র মোমের আলোয় সত্যজিৎ আমাদের কাছে চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলেন। ছবির প্রায় শেষের দিকে দেখি মোমের আলোর পাশে বসে সোমনাথ তার বৌদির সঙ্গে কথা বলে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই সোমনাথের চোখ দুটো, মোমের আলোর মতই যেন জ্বলছে। ‘অশনি সংকেত’-এ চরিত্রদের বসা আর চলার মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ যেন বাংলার গ্রামীণ জীবনের মূল সুরটি ধরতে চেয়েছেন। একটি দৃশ্যে যদি তারা বসে থাকে, তাহলে পরের দৃশ্যেই তারা হেঁটে চলে। এ যেন মানুষের জীবনযুদ্ধে লড়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগে, একটু থিতু হয়ে জিরিয়ে আবার ওঠে দাঁড়ানো। এই ওঠা আর বসার মধ্যে দিয়ে যেন তারা জীবনযুদ্ধে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। একই রকম শহুরে জীবন সংগ্রাম আমরা দেখি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে। ছবির শুরুতে শুধু টাইলেই দেখা যায় বাসের বাদুড় ঝুলা মানুষ বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু হাতের কয়েকটা ক্লোজ আমাদের এই জীবন সংগ্রামের আগাম ইঙ্গিত জানিয়ে দেয়। যে সংগ্রামের মুক্তি ঘটে সিদ্ধার্থের মফস্বলে যাওয়ার পর পাখির ডাকের মধুর গুঞ্জনে। পাখির গুঞ্জন এই ছবিতে মুক্তি বা স্বাধীনতার এক অপূর্ব বার্তা আমাদের কাছে নিয়ে আসে। এর ঠিক বিপরীত চিত্র পাই ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির শ্যামলেন্দু এবং তার স্ত্রী দোলনের চরিত্রে। স্বামীর মতোই দোলন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মনে টাইটেলে দেখানো প্রতীক-চিহ্নগুলো শুধু কাজ করে। বড় ফ্ল্যাট, দোলনের নিয়মিত পার্লারে যাওয়া, রেসের মাঠে যাওয়া, শেরি পান, নাইটক্লাব- এই সবই যেন তাদের নির্বিগ্ন জীবনের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ‘পরশ পাথর’-এর পরেশ বাবু (তুলসী চক্রবর্তী) পরশ পাথরের মাধ্যমে ধনী হয়েও নির্লোভ থেকে যান। হাতের মুঠোয় অতুল ক্ষমতা হঠাৎ পেলেও তার অপব্যবহার করা উচিত নয়- এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই যেন পরেশের চরিত্রে ফুটে ওঠে। ছবিতে তাই ‘টুপি’ একটি চমৎকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গান্ধীটুপিতে তার টাক ঢেকে রাখা মন্ত্রীদের পরিহাস করে যেন তৃপ্ত হয়েছিলেন পরেশবাবু। ভোটে নামতে গেলে বিদ্যাবুদ্ধির প্রয়োজন নেই। তাই পরেশবাবু নিজেই ভোটে নামতে দ্বিধা করেন না। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সময়ের ছবি ‘জলসাঘর’-এর জমিদার বিশ্বম্ভর রায় (ছবি বিশ্বাস) একাই যেন সেই ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সময়ের প্রতিভূ হয়ে দেখা দেন। এভাবে সত্যজিতের ছবিগুলো যত পর্যবেক্ষণ করি ততই যেন নব নব রূপে এসব ডিটেল আমাদের চোখের সামনে এসে ধরা দেয়।
শুধু অ্যাটমসফিয়ারিক বা বিহেভিয়ারিস্টিক ডিটেল নয়- কী সময় বিবেচনায়, কী ইতিহাস চেতনায়, কী চরিত্র ব্যঞ্জনায়, কী চরিত্রদের মুখের -চোখের অভিব্যক্তি, তাদের হাঁটা-চলা, থেমে যাওয়ার ব্যঞ্জনায়, কী সংলাপের ব্যঞ্জনায় এমনকি আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে পর্যন্ত অপূর্ব সব ডিটেল সত্যজিতের ছবিতে আমরা পাই। তার ছবির আবহসঙ্গীতের ডিটেল একেবারে পৃথক একটি আলোচনার দাবি রাখে। স্বল্প পরিসরের কারণে এখানে তা করা হলো না। এসব ডিটেলের কারণেই সত্যজিতের ছবি এতো স্পষ্ট, নিখুঁত এবং হৃদয়গ্রাহী হয়। আধুনিক মনে হয়। ঠিক যেমন আধুনিক মনে হয় ‘বাইসাইকেল থিফ’, ‘ওয়ান হান্ড্রেড ব্লোজ’, ‘সিনেমা প্যারাডিসো’, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘ড্রিম’ বা ‘ইকিরুর’ মতো পৃথিবীর সব মহান ক্লাসিক ছবি। যা হৃদয়ে স্থান করে নেয়, তা স্মৃতিতেও স্থান করে নেয়। আর তাই আজও আমরা সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ভবিষ্যতেও স্মরণ করে যাব।

ফ্লোরা সরকার