শুক্রবার, ৬ মে, ২০১১

সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকতায়

এক জীবনে একজন কবির জন্মশত ও সার্ধ শতবার্ষিকী দেখার সুযোগ আমরা যারা লাভ করেছি, তারা ভাগ্যবান। আরও বেশি সৌভাগ্যশালী তারা, যারা দু’টি উপলক্ষই প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত বয়সে, সুস্থ মননে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী পালিত হয় ১৯৬১ সালে, তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার অধিবাসী। পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ‘অমুসলিম’ কবিকে নিয়ে মাতামাতি শাসক শ্রেণীর কাছে সুখকর মনে হওয়ার কথা নয়, এবং তা মনে হয়ওনি। যদিও রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আদেশ তখনও জারি করা হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তখন ঢাকার সাহিত্যজগতের নেতৃত্বে ‘সমকাল’ নামক সাহিত্য মাসিক। কবি সিকান্দার আবু জাফরের মতো সিংহপুরুষ, সহযোগী কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে নিয়ে অকর্ষিত জমিকে শস্য শ্যামলা করার মতো ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে সাহিত্যের শস্যভাণ্ডার সৃষ্টির ব্রত নিয়ে সমকাল বের করেন এক বৈরী সময়ে।
গত শতকের ষাটের দশক আমাদের সাহিত্যজগত তার পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে উজ্জ্বল দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তার অনেকটা কৃতিত্বেরই দাবিদার সমকাল।
টিকাটুলির অভয় দাস লেনের একতলা প্রায়ান্ধকার বাড়ি থেকে প্রকাশিত মাসিক সমকাল পত্রিকার অফিসটি ছিল প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের এক মিলন ক্ষেত্র আর এর প্রধান সেনাপতি ছিলেন সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর। তিনি শুধু সম্পাদনার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেননি। তখনকার দিনে বিভিন্ন উপলক্ষের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন একজন সফল সংগঠক হিসেবে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী সমাগত। যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উপলক্ষটি উদযাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো তখনকার দিনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের। নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে আয়োজনে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হলো। অধ্যাপক আবুল ফজল, কবি সুফিয়া কামাল তখন আমাদের সাহিত্যজগতের উজ্জ্বল নাম। অধ্যাপক আবুল ফজল চট্টগ্রাম নিবাসী। কবি সুফিয়া কামাল ঢাকায়। শুধু তাই নয়, সমকাল অফিসের পাশেই একই সড়কে তাঁর বসবাস।
এই ধারার নিষেধাজ্ঞার ফলে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যারা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদযোগটি নিলেন, তারা নিষেধের অচলায়তন ভাঙার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তা করলেন। সমকাল পত্রিকার অফিসে প্রতিনিয়ত সভা করে জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের কর্মসূচি প্রণয়নের কাজের সঙ্গে সঙ্গে সমকালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। অন্যূন শত পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় দেশের সেরা লেখকদের লেখা অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা সম্পাদক উচ্চকণ্ঠেই জানিয়ে রাখলেন।
রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা কারা লিখবেন, কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হবে এই সংখ্যায় লেখার জন্য, তার তালিকা তৈরি করে নানারকম কাটছাঁটের পর চূড়ান্ত করা হলো। লেখা চেয়ে নির্বাচিত লেখকদের কাছে চিঠিও গেল। আজ ভাবতে অবাক লাগে, কী এমন সুকৃতির অধিকারী ছিলাম যে একটি চিঠি আমার নামেও পাঠানো হয়েছিল! সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের স্নেহ ও ঔদার্যের কারণেই যে লেখক তালিকায় ছন্দপতন ঘটেছিল, আজ এত বছর পরে বুঝতে কষ্ট হয় না।
লেখার সুযোগ পেয়ে মনে হয়েছিল শতাব্দীর সূর্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে পারা, তাও বিশেষ সংখ্যায়, অবশ্যই একজন লেখকের জন্য বিরল সুযোগ এবং এই সুযোগের সদ্ব্যবহার নির্ভর করে লেখকের ব্যক্তিগত যোগ্যতার ওপর। লেখার সুযোগ পাওয়াকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচনে বেশ চিন্তিত থাকতে হয়েছে কিছুদিন। রবীন্দ্রনাথের গল্প কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও লেখা হবে।
বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে পঠন তালিকায় রবীন্দ্র-সাহিত্যের শীর্ষ অবস্থানের কারণে তাঁর সাহিত্য নিয়ে শিক্ষকদের আলোচনা, সহায়ক গ্রন্থ আমাদের, ছাত্র-ছাত্রীদের রবীন্দ্র-সাহিত্য সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিল, তা তখনকার দিনে মনে হতো মুগ্ধতাবোধ দ্বারা প্রভাবিত। দু-একজন শিক্ষক রবীন্দ্র-কবিতার প্রসঙ্গে ভাবাবেগে আক্রান্তও হতেন। আজ এত বছর পর মনে পড়ে একজন ডাকসাইটে শিক্ষক রবীন্দ্র-কাব্যকে তুলনা করেছিলেন কাঁচাগোল্লার সঙ্গে। মুখে দিলেই যা মিইয়ে যায়। কী স্থূল উপমা!
আমরা চেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথকে তার সবলতায় ও দুর্বলতায় আবিষ্কার করতে। সুতরাং ছিদ্রান্বেষণের মতো সন্ধান করতে লাগলাম রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক। যেদিকে তাকাই, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সোনালি ফসল। কী গান, কী কবিতা, কী গল্প, কী প্রবন্ধ, কী উপন্যাস। এমন সফল লেখক এর আগে বাংলা সাহিত্য আর পায়নি। তিনি যদি আর কিছু না লিখে শুধু গানই লিখতেন, তাতেও অমরত্বের দাবিদার হতেন। এবং কট্টর রবীন্দ্র সমালোচকেরও মতে, কালের প্রহার এড়িয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যের যা বেঁচে থাকবে, তা হলো তার গান।
তা হলে কি রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক বলতে কিছু নেই? অবশ্যই আছে। মহাবীর একিলিসের দুর্বলতা যেমন ছিল তার পায়ের গোড়ালির নিচে, স্যামসনের কেশরাজি, রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্বল দিক মনে হয়েছে তাঁর সমালোচনামূলক রচনাবলী। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রিয়জনদের লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি, তখন মনে হতো, লেখার দুর্বলতার দিক এড়িয়ে লেখককে উত্সাহ দেয়ার জন্য প্রশংসাসূচক কথাবার্তাই বেশি বলতেন।
কিছু নমুনা লেখা জোগাড় করে একটি নিবন্ধ ফেঁদেছিলাম—‘সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ’।
‘সমকাল’ রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যার সব লেখাই মানোত্তীর্ণ ছিল, এমন দাবি সম্পাদক নিজেও করেননি। ফসলের সঙ্গে আগাছাও জন্মায়। তেমনি মূল্যবান সব লেখার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেই বালখিল্য ও অপরিণত নিবন্ধটি, যার অস্তিত্ব আজ অস্বীকার করতে পারলে খুশিই হতাম!
সমকালের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশের কিছুদিন পর নিউ মার্কেটের অধুনাবিলুপ্ত বইয়ের দোকানে একটি বিশালাকার গ্রন্থের উপস্থিতি তখন যে কী পরিমাণ মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছিল, আজ তা ভাবলে অবাক হই।
ভারতের সাহিত্য একাডেমী প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর : এ সেন্টেনারি ভল্যুম (১৮৬১-১৯৬১) হার্ড কভারের গ্রন্থটি প্রথম হাতে নিয়ে যে অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়, আজ তার বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। সেই কালে ছয়শ’ টাকা দিয়ে বইটি কিনে অবিমৃষ্যকারিতার প্রমাণ যে দিয়েছিলাম, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম পরবর্তী সময়ে জীবন ধারণে কৃচ্ছ্রতাসাধনে বাধ্যবাধকতার কারণে! কিন্তু কৃচ্ছ্রতা হাসিমুখে সয়েছি অর্জিত সম্পদের ঐশ্বর্যে।
বইয়ের ভেতরে যত দেখি, মুগ্ধতা কেবলই বাড়ে। বিশাল গ্রন্থটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন দার্শনিক পণ্ডিত এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ। লেখকসূচি দেখে আরও চমকিত হই। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুলক রাজ আনন্দ, লীলা মজুমদার, ধুর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর, ড. নীহার রঞ্জন রায়, বুদ্ধদেব বসু, ভবানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। দেশি লেখকদের তুলনায় বিদেশি লেখকদের তালিকাটি আরও সমৃদ্ধ। এমন সব লেখকের নাম রয়েছে যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য প্রবাদতুল্য। রবীন্দ্র-সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের নিবিড় সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। এ তালিকায় রয়েছেন লেনার্ড এলমহার্স্ট, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার নাম রেখেছিলেন বিজয়িনী), ‘গুড আর্থ’, ‘মাদার’ উপন্যাস খ্যাত পার্ল এস বাক, সিসেপ তুসি, নোবেল বিজয়ী রিচার্ড চার্চ, তোশিহিকো কাতাইমা, আরনল্ড কাইজার লিং, জোসেফ লায়েনবাচ, অ্যান্ডারস ওস্টার লিং, চীনা পণ্ডিত পিং-সিন, আলবার্ট সোয়েত্জার, মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট, আইসল্যান্ডের নোবেল বিজয়ী ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট পিপল’ উপন্যাস খ্যাত হ্যালডর কিলিয়ন ল্যাক্সনেস, পোল্যান্ডের লেখক টাডেউত্ পোবোজনিয়াক ও স্টেলা ক্রামরিশ। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর লেখক পরিচয়ে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়।
দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে তার জন্মশতবার্ষিকীতে এর চেয়ে সমৃদ্ধ কী আর উপহার দিতে পারত জন্মভূমি ভারত? বন্ধনহীন উত্সাহে ভারতে উদযাপিত হয় কবির জন্মশতবার্ষিকী। পক্ষান্তরে বাংলাভাষী তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে কবির জন্মবার্ষিকীর উদ্যাপন ছিল সাহসে-ভরা অচলায়তন ভাঙার মতো ব্যাপার। প্রাণের উচ্ছ্বাসে যা ছিল সমৃদ্ধ।
আয়োজনে হয়তো ছিল না জৌলুস, ছিল না আড়ম্বর। কিন্তু সেসব আয়োজনের আন্তরিকতা, আজ এত বছর পরে যখন রবীন্দ্র উত্সব উদযাপিত হয় রাষ্ট্রীয়, সরকারি আনুকূল্যে, পরিমাপ করার সাধ্য কি বর্তমান সময়ে? আয়োজনের দীনতা ঢাকা পড়ে গেছে আবেগ আর আন্তরিকতায়। সমকালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যা এ দেশে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে তাই এক মাইলফলক।
\ ২ \
পঞ্চাশ বছর পরে উদযাপিত হচ্ছে কবির সার্ধ শতবার্ষিকী। বিশ্বব্যাপী আয়োজনের ঘনঘটা। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। এবার শুধু বাধা-বন্ধনহীন পরিবেশেই নয়, সম্পূর্ণ অনুকূল বাতাবরণে উত্সবের আয়োজন হচ্ছে দেশব্যাপী। এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে এর প্রস্তুতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের নতুন সংস্করণ ও তার সম্পর্কে নতুন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশেও। এবং এর সূচনা হয়েছে গত বছর আগস্ট মাসে ‘শুধু রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটি প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। বিগত বছরে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিকের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলী থেকে নির্বাচিত পঁচিশটি রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন বহুমাত্রিক লেখক শাহাবুদ্দীন নাগরী। চন্দ্রাবতী একাডেমী প্রকাশিত এই প্রবন্ধ সংকলনটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে গণ্য হবে। সুমুদ্রিত এই সংকলনটি রবীন্দ্রচর্চায় গতির সঞ্চার করে।
বিদেশে ইতিমধ্যে বেশ কিছু রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘এ টেস্ট অব টেগোর : পোয়েট্রি, অ্যান্ড প্লেইজ। সম্পাদনা : মেরিন শ্যাপল্যান্ড, প্রকাশক : গ্রিন বুক্স্।’ ‘এম্পায়ার, ন্যাশনালিজম অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড। মাইকেল কলিন্স। বুটলেজ পাবলিকেশন্স।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে চার খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী। সিলেকটেড পোয়েমস, রাইটিংস অন লিটারেচার অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ, সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ, সিলেক্টেড রাইটিংস ফর চিলড্রেন।
আর সভা-সমিতি তো নিয়মিতই আয়োজন করা হচ্ছে। এ বছরের ১২ এপ্রিল ইলিনয়ের আরবালা, শ্যাম্পেনের চ্যানিং-মারে ফাউন্ডেশনে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়াম ও প্রদর্শনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রথম অনুষ্ঠান এবং এটাই হওয়া স্বাভাবিক। কেননা এই আরবানা-শ্যাম্পেন ভ্রমণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক। সেটা ১৯১২ সালের কথা। এরও ইতিহাস আছে। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরেক ছাত্র সন্তোষ মজুমদারকে আরবানা-শ্যাম্পেনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পাঠান কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। (কলকাতা জোড়াসাঁকোর বনেদি ঠাকুরবাড়ির জাতকের কৃষিসংলগ্নতার প্রমাণ এর মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত)। ১৯০৬-১৯১০ সালে সেখানে তারা পাঠ শেষে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্নাতকোত্তর লেখাপড়া না করে রথীন্দ্রনাথ আরবানা ত্যাগ করেন। ১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ প্রথম আরবানা আসেন। দুই বার রবীন্দ্রনাথ ইলিনয়ে এসেছিলেন। শেষবার রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছিলেন ১৯৩০ সালে। সেবার নিউইয়র্কে তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কের তত্কালীন গভর্নর ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট (পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং তিন টার্মে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট), নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন উপন্যাসিক সিনক্লেয়ার ল্যুইস এবং আরো পাঁচশ’ অতিথি।
এর আগে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ আর একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ফলে স্বাভাবিক কারণেই তখন তাঁর বিষয়ে উত্সাহ অনেক বেশি। সম্মানীর বিনিময়ে তিনি বক্তৃতা দেন। প্রতি বক্তৃতায় আয় তাঁর সাতশ’ থেকে হাজার ডলার, পশ্চিমের বস্তুতান্ত্রিকতার সমালোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। সমালোচনা থেকে বাদ যায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
মিনেপলিস ট্রিবিউন পত্রিকা লিখল : ভারতবর্ষের সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ। গালমন্দ শুনতে একজন মার্কিনীকে গচ্চা দিতে হয়েছে সাতশ’ ডলার।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে মার্কিনিদের শ্রদ্ধাবোধ আজও কিছু কমেনি।
বর্তমান জটিল বিশ্বে তাদের কাছে কবিকে অনেক প্রাসঙ্গিক মনে হয়। যার প্রকাশ ঘটবে বর্ষব্যাপী আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্তমান সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীতে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর সাহিত্যকর্ম পাঠ করে দিশা পাওয়া যেতে পারে বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মহামানবের’ আগমন বার্তা শুনেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে একজন মহামানব প্রত্যাশিত হলেও মানবজাতি তার আগমন বার্তা শুনছে না। বর্তমান সময়ের এটাই বড় সঙ্কট। 

                                                                                                                  - ফ খ রু জ্জা মা ন চৌ ধু রী