বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১

সিনেমার মৃত্যু এবং সাই মিং লিয়াং

২৬ মার্চ ২০১০, মালয়েশিয়ার বংশোদ্ভূত তাইওয়ানে বেড়ে ওঠা সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সাই মিং লিয়াং তাইওয়ানের ন্যাশনাল সেন্টার ইউনিভাসির্টির একটি থিয়েটার হলে তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’-এর প্রিমিয়ার উপলক্ষে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতায় সিনেমার মৃত্যু, ফ্রান্সের অন্যতম চিত্রনির্মাতা ত্রুফোর প্রভাব ও অন্যান্য প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ প্রদান করেন।

সাই মিং লিয়াং মালয়েশিয়ার কুচিং প্রদেশে ১৯৫৭ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের প্রথম ২০টি বছর মালয়েশিয়ায় অতিবাহিত হয়। তারপর বাবার কর্মসূত্রে তাইওয়ানের তাইপেতে চলে আসেন। তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সিনেমা বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। পরবর্তীতে থিয়েটারের প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্র পরিচালক এবং হংকং টেলিভিশনের নাট্য পরিচালক হিসেবে নানা কাজে লিপ্ত হন। তবে চিত্র পরিচালক হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন বেশি। ১৯৯৪ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার নির্মিত Vive L’Amour ছবিটি গোল্ডেন লায়ন (শ্রেষ্ঠ ছবি) পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৯৭ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার ‘রিভার’ ছবিটি সিলভার বিয়ার বা শ্রেষ্ঠ জুরি প্রাইজ লাভ করে। ‘দ্য হোল’ ছবিটি ১৯৯৮ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে FIPRESCI award পায়। নান্দনিক সৌন্দর্য্যের জন্য ২০০৫ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে The Wayward Cloud ছবি আলফ্রেড বাউয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং সিলভার বিয়ার পায়। ২০০৭-এ I don’t Want to Sleep Alone ছবিটি যা মালয়েশিয়ায় চিত্রায়িত হয় এবং যে ছবিটি সেদেশের সংস্কৃতিগত, নৃতাত্ত্বিকগত এবং জাতিগত নানান অনালোকিত বিষয় উপস্থাপন করার কারণে মালয়েশিয়ান সেন্সরশিপ প্রথমে ছবিটি মুক্তি দিতে অপারগতা জানায়। পরে ছবির কিছু অংশ বাদ দিলে ছবিটি মুক্তি পায়। বছর দুয়েক আগে লুভ মিউজিয়ামের আর্থিক সহায়তায় তার সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’ ইতিমধ্যে দর্শককুলে বেশ আলোড়ন তুলেছে। সব থেকে যা উল্লেখযোগ্য তা হলো- ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বিশ্বের ৪০টি শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালকের মাঝে তাকে ১৮তম স্থানে স্থান দিয়ে সম্মানিত করে।
  সেই লিয়াং তাইওয়ানের একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হলে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন। পরিত্যক্ত সেই সিনেমা হল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শেষবার যখন এই থিয়েটার হলে আসি সেটা ছিল ২০০৩, যখন লি ক্যাং শেং (লিয়াংয়ের একমাত্র অভিনেতা, যিনি লিয়াংয়ের সব ছবিতে অভিনয় করেন, যাকে ছাড়া লিয়াংয়ের ছবি পূর্ণ হয় না) অভিনীত The missing-এর প্রিমিয়ার শো দেখানো হয়। এখানে যারা আছেন তাদের মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষই জানেন, এই হলের আসনগুলো ফু-হো থিয়েটার, যে থিয়েটারে ৮ থেকে ৯শ’ দর্শকের বসার ব্যবস্থা ছিল, সেখান থেকে আনা হয়েছে। সেই থিয়েটারে আমার অন্য একটি ছবি Goodbye, Dragon Inn’র (2003) শুটিং হয়েছিল। সেই সময় থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি সিনেমা হল বা থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠার একান্ত সমর্থক ছিলাম। ফু-হো থিয়েটার হলটি ভেঙে দিলে সেখানকার বেশিরভাগ আসন এখানে স্থানান্তরিত করা হয়, যেগুলো স্ত্তপ করে রাখা হয়েছিল অনেকদিন। আমার খুব ভালো লাগছে সেই হলের আসনগুলো এখানে কাজে লাগানো হয়েছে দেখে।…থিয়েটার হল সিনেমা শিল্পের অন্যতম একটি অপরিহার্য অংশও বটে।’’
    সিনেমার প্রতি শুধু প্রেম নয়, দরদ থাকলেই কেউ এভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং তা বাস্তবায়িত করতে পারেন। আমরা আমাদের অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের কথা কী ভাবতে পারি না, যেখানে দেশীয় ছবির পাশাপাশি পৃথিবীর নান্দনিক, সুস্থ, সুন্দর ছবিগুলো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিতভাবে দেখার সুযোগ পাবে?
    ভেনিসে তার বেশ কিছু ছবির একবার প্রদর্শনী হলে সেখানকার একজন ডাচ সমালোচক লিয়াংয়ের ছবি সম্পর্কে একটি চমৎকার মন্তব্য করেন এবং তা হলো – ‘‘সাইয়ের কাজ, সিনেমার মৃত্যু ঘটানোর মতো কাজ এবং একই সঙ্গে তা (সিনেমা) পুনরুজ্জীবিত করারও কাজ।’’ এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে লিয়াং বলেন, ‘‘তার মন্তব্যের সব থেকে উদ্দীপক দিকটি হচ্ছে সিনেমার ‘পুনরুজ্জীবন’। সিনেমার ইতিহাসে আমরা প্রায়ই সমালোচকদের মুখে সিনেমার মৃত্যুর কথা শুনে থাকি। আশির দশকে এই ধরনের একটি আলোচনার ঝড় উঠেছিল যে, তাইওয়ানের ছবির মৃত্যু ঘটেছে। আসলে তা কী ছিল? এই আলোচনায় দর্শকরা বেশ ঘাবড়ে যান। গত বছর একজন জ্যেষ্ঠ জার্মান চিত্রপরিচালকের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং তিনিও বলেন, ১৯৮৪-এর দিকে, জার্মানির অন্যতম পৃথিবী খ্যাত চিত্র পরিচালক রেইনার ওয়ারনার ফাসবিন্ডারের মৃত্যুর (১৯৮২) পর পরই জার্মানিতেও ঠিক একই রকম আওয়াজ উঠেছিল অর্থাৎ জার্মান ছবির মৃত্যু ঘটে গেছে। জার্মান সরকার সিনেমার জন্যে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় এবং চিত্রনির্মাতারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সরকারি ঘোষণায় বলা হলো ছবি নির্মিত হবে সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য, ঠিক যেমন হলিউডে করা হয়। ফলে আশির দশকের পর থেকে যেসব ছবি সেখানে নির্মাণ করা হলো তার কোনো পরিচালকের নামই আমরা এখন আর করতে পারি না, অথচ আশির দশকের আগের সময়কার নির্মাতা যেমন ওয়ারনার হারজগ, ফাসবিন্ডার, উইম ওয়েন্ডার এদের নাম এখনো আমরা স্মরণ করি। আমি মনে করি এসবই বাজারিকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটু কমবেশি হলেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্প এরকম জাতীয় সিনেমার মৃত্যু ঘণ্টার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বা করছে। ছবির এই মৃত্যু বা উজ্জীবিত অবস্থা যাই হোক না কেন, আমার ছোটবেলাকার সময়ের কথা আমি বলতে পারি সেই সময়ে জনগণের জায়গার জন্য সিনেমা একটি অত্যন্ত আবশ্যকীয় স্থান ছিল। যা আপনারা আমার ‘ফেস’ ছবিটিতে দেখতে পাবেন।’’ অর্থাৎ সিনেমার যে মৃত্যু নেই, মৃত্যু হতে পারে না সে কথাই লিয়াং চমৎকার করে উপস্থাপিত করেছেন। বলাই বাহুল্য, আমাদের আজকের সিনেমা শিল্পের এই আকালের যুগে আমাদের চিত্রনির্মাতারাও লিয়াংয়ের কাছ থেকে প্রচুর অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।
   শিল্প ও অ-শিল্প সম্পর্কে বলেন, ‘‘ছবি যদি শিল্প হয় তাহলে সেই কাজের ভেতর অবশ্যই একজন শিল্পীর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অবশ্যই কিছু বাণিজ্যিক ছবি নির্মিত হবে যেগুলোতে অনেক সময় শৈলীর ছোঁয়া পাওয়া যায় কিন্তু আমি শুধু মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে ছবি নির্মাণ করি না। আমার ছবি আমার সৃষ্টির প্রতিফলন; আমার ছবি আমার জীবন থেকে অবিচ্ছিন্ন।’’ এই হলেন সাই মিং লিয়াং, ছবিকে যিনি মনেপ্রাণে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কোনো মুনাফা উপার্জনের পথে হাঁটেননি। হাঁটেননি বলেই একের পর এক তার প্রায় সব ছবি পুরস্কৃত হয়েছে এবং হবে। এই প্রসঙ্গে তার সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানে একটি কোরিয়ান রেস্তোরাঁয় বারবিকিউ খাওয়ার অভিজ্ঞতার একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানে তিনি যখন খেতে বসলেন বারবিকিউর সঙ্গে লেটুস পাতা বা কোরিয়ান হট সস দেওয়ার কথা বললে মালিক উত্তরে বলেন, ‘‘আমরা তাইওয়ানিরা সাধারণত বারবিকিউয়ের সঙ্গে এসব পরিবেশন করি না।’’ লিয়াং তখন মুচকি হেসে তার বক্তৃতায় বলছেন, ‘‘তাহলে স্থানীয় স্বাদ বজায় রেখে শুধু টাকা উপার্জনের জন্য কোরিয়ান রেস্তোরাঁ খোলার কী দরকার? আপনি যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন কী কারণে কোরিয়ান রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছে। সেখানে দেখবেন বেশ কিছু কোরিয়ান টিভির পপুলার সোপ অপেরার পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে দর্শকের দৃষ্টি পপ-কোরিয়ান ধারার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।’’ অনেকটা আমাদের দেশের বড় বিপণিগুলোতে ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য যেমন আমরা ভারতীয় ছবির বিভিন্ন বলিউড স্টারদের ছবি ঝুলিয়ে রাখি।
    লিয়াং দুঃখ প্রকাশ করেন তার বিশ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা ইতালির নিও রিয়ালিজম বা ফাসবিন্ডারের কোন ছবি দেখা হয়নি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার বা স্থানীয় ফিল্ম স্টুডিওগুলো খুব বাছাই করা ছবি নির্মাণ বা আমদানি করত। তারা শুধু ছবির বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে ছবির আমদানি বা নির্মাণ করত। ভালো ছবি দেখার জন্য তাদের কোনো ফেস্টিভ্যালের অপেক্ষা করতে হতো। যদিও পরবর্তীতে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়, তবু বেশিরভাগ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে হয় শুধু বাণিজ্যিক ছবি চলে না হলে অন্য কোনো ছবি নয়। লিয়াংয়ের বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দেশের সিনেমা শিল্পের অনেক মিল খুঁজে পাই। তবে তাইওয়ানে এই শিল্পের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। আশির দশকে মার্শাল ল’ তুলে নেয়ার পর হলিউডের মূল ধারার ছবির আগমন ঘটে, সেন্সরশিপের কড়াকড়ি শিথিল হয় ফলে বেশ স্বাধীনভাবে এখন নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করতে পারেন।
   তার ‘ফেস’ ছবি প্রসঙ্গে লিয়াং বেশ কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আমাদের দেন। যারা ত্রুফোর ‘ফোর হান্ডড্রেড ব্লোউজ’ দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই সেই ছোট্ট বালকটির কথা মনে আছে, সেই বালক পরবর্তীতে যিনি Jean-Pierre Leaud নামে সিনেমা জগতের অভিনয়ে বেশ নাম কুড়িছেন, লুভ মিউজিয়াম যখন তাকে ছবি করার জন্য আর্থিক সহায়তার কথা বলেন এবং জিজ্ঞেস করেন কাকে নিয়ে তিনি ছবি নির্মাণ করতে চান, লিয়াং এক বাক্যে তার নাম বলে ফেলেন। আরো জানান এই লুভ মিউজিয়ামেই তাকে নিয়ে সেই ছবির শুটিং পর্ব পরিচালনা করবেন। কারণ হিসেবে লিয়াং বেশ চমৎকার একটি কথা বলেন, ‘‘জ্যঁ পিয়েরকে মিউজিয়ামেই ঠাঁই দিতে হবে, না হলে খুব দ্রুত তাকে সবাই ভুলে যাবে। কেননা সিনেমার ইতিহাসে তার নাম থেকে গেলেও, ফ্রান্সের বর্তমান বা পরবর্তী প্রজন্ম তাকে ভুলে যাবে। অর্থাৎ আমি খুব সচেতনভাবেই তাকে নিয়ে এভাবে ছবি নির্মাণ করেছি, কেননা সাধারণ এবং এশিয়ান দর্শক ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা জার্মান নিউ ওয়েভ সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখে। ছবিটির মাধ্যমে সেসব ধারার কথা আবার সবার স্মরণে আসবে। অনেকে ছবিটিকে আত্মপ্রতিকৃতি বলে সমালোচনা করেছেন। আমি মূলত জীবন এবং সৃষ্টির মাঝের সম্পর্ক খুঁজে বেড়াবার চেষ্টা করেছি। মানুষ তার বার্ধক্য, জরা, মৃত্যু থেকে রেহাই পেতে পারে না। কিন্তু এসব মেনে নিয়েও বলা যায় জীবন আসলে একটি অনন্ত বৃত্তের, জীবনের ভেতর থেকেই জীবন ফিরে আসে।’’ অসাধারণ দার্শনিক জায়গা থেকে নির্মিত হয়েছে তার সর্বশেষ ছবি ‘ফেস’।
   সিনেমার বাণিজ্যিকীকরণের চরম বিরোধী লিয়াং। তার ভাষায়, ‘‘ফিল্ম শুধু বিনোদনের ক্ষেত্র নয়। জ্যান হাং তেজ যেমন বলেছেন, কোনো বই পড়ার অর্থ নিজেকে বদলে দেওয়া, সিনেমাও ঠিক তাই। এখন মানুষ বই পড়ার চেয়ে সিনেমা দেখে অধিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন ধরনের সিনেমা সে দেখে? বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ছবি। আমার ‘ফেস’ ছবি দেখে হংকংয়ের একজন দর্শক বলেছেন, ‘যাচ্ছেতাই’ আবার হংকংয়েরই আরেকজন দর্শক বলেছেন, ‘ছবিটি দেখে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। প্রতিটি শট বলে দিচ্ছিলো কতটা শ্রম আর কষ্ট দিয়ে তৈরি ছবিটি।’ ছবি দেখা আসলে দু’ঘণ্টা হলে বসে ছবির সঙ্গে ভালোবাসাবাসির বিষয়। এর সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকে মনে করেন ছবি নির্মাণের মাধ্যমে সেই দেশের বিজ্ঞাপনেরও একটা ব্যবস্থা করে। আমি মোটেও তা মনে করি না। তাই আমি যা মনে করি তাই নির্মাণ করি। কে দেখলো আর না দেখলো তার ধার ধারি না। একবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় ছবি বিষয়ে কথা বলার জন্য। সেখানে দর্শকের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন রাখা হয় আর তা হলো, ‘ সিনেমার বস কে?’ একটি ছাত্র বললো ‘আমি’। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘না। ছবি নির্মাণ করি আমি, কাজেই তুমি আমার বস কখনো হতে পারো না। তুমি আমার ছবি দেখতে নাও পার, কিন্তু তুমি কখনোই আমার বস্ হতে পার না, যেমন আমিও পারি না তোমার বস হতে।’
    ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ থেকে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন লিয়াং। ছবির শেষ দৃশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ছেলেটি যখন বিচে গিয়ে দর্শকের দিকে মুখ ঘোরায় তখনই দর্শক এবং ছবির পর্দা একটি মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ছবি তখন দর্শকের সঙ্গে যেন মুখোমুখি কথা বলে ওঠে। সে সমস্যার কথা জানায় কিন্তু কোনো সমাধান দেয় না। ছবিটি আপনাকে কোনো উৎসাহ যোগাবে না, কিন্তু বার বার আপনাকে ধাওয়া করে বেড়াবে। কেন? এখানেই কল্পনার শক্তি লুকিয়ে থাকে। মানুষকে ভাবিয়ে তোলার শক্তিটি লুকিয়ে থাকে। আর আমার ছবিতে এই ভাবিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।’’ আমরাও লিয়াংয়ের সঙ্গে একমত। যে কোনো শিল্পমন্ডিত ভালো মানের ছবি মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। নিজের বা নিজেদের অবয়বে নিজেকে বা নিজেদের দেখতে সহায়তা করে। কোনো ছবি দেখে যদি ভাবতেই না পারলাম, চিন্তা করতে না শিখলাম, নিজেকে বা নিজেদের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে না পারলাম তাহলে ছবি নির্মাণের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই ছবি যত মূল্যেই বিক্রীত হোক তাতে কিছু এসে যায় না। এই কল্পনা শক্তির মাঝেই বেঁচে থাকে সিনেমা। আশা করি আমাদের নির্মাতারও লিয়াংয়ের মতো ব্যবসা সফল নয়, ভাবনা সফল ছবি নির্মাণে আরও উদ্যোগী হবেন। তাহলে আমাদের সিনেমাকেও আমরা এভাবেই বেঁচে থাকতে সহায়তা করতে পারব।
             ---ফ্লোরা সরকার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন